দিদাও হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার জ্বালা যদি বুঝতিস রেণু! একটা পাঁড় মাতালের ঘর করি, ঘাড়ের ওপর পাঁচটা সোমথ মেয়ে। কী সুখে আছি বল! তার ওপর এই মেয়ে মুখে চুনকালি দিয়ে গেল। গলায় দড়ি জুটল না ওর?
সারাদিন ধরে থেকে থেকে এইসব বিলাপ। লোকটিকে আগে কখনও দেখেনি। রোগাভোগা মানুষ, সরল সোজাও বটে। দিদাকে তার খারাপ মানুষ মনে হয়নি। রমা মাসির সেজদি ক্ষমাও খুব ভাল। দেখতে রমার মতো নয়। একটু মোটাসোটা আহ্লাদি চেহারা। তবে কেঁদে কেঁদে চোখ লাল, মুখখানা দুঃখে ভার।
বন্দনাকে বলেছিল, আমাদের বোনে বোনে খুব ভাব ছিল। রমা সবচেয়ে নরম মনের মেয়ে। হ্যাঁ রে, কেন এরকম হল? রমা তো এরকম ছিল না।
বন্দনা কান্না চেপে বলেছিল, আমি জানি না মাসি।
জামাইবাবুকে তো আমি কখনও দেখিনি। তবে শুনেছি উনিও খুব ভাল মানুষ।
আমার বাবা খুব ভাল।
ক্ষমা মাসির সঙ্গে তার তেমন ভাব হল না বটে, কিন্তু বন্দনার এই মাসিটিকে খুব খারাপ লাগল না। তার ওপর একটা লজ্জার ঘটনা ঘটে যাওয়ায় তারা খুব মনমরা।
হীরেনবাবু তখন প্রায় রোজ বিকেলের দিকে আসতেন এবং মেঘনাদকে শিগগিরই অ্যারেস্ট করে আনবেন বলে তড়পাতেন। তাঁকে চা-বিস্কুট আর জদা পান দেওয়া হত। তিনি মাঝে মাঝেই মাকে জিজ্ঞেস করতেন, মেঘনাদবাবু নগদ টাকা কত নিয়ে গেছে বলে আপনার মনে হয়? গয়না টয়না নেয়নি তো!
বন্দনার খুব রাগ হত শুনে। তার বাবা কি চোর?
দিদা একদিন হীরেনবাবুকে বলল, জামাই আমার হিরের টুকরো ছেলে। ওর কোনও দোষ নেই। আপনি আমার মেয়েটাকে চুলের কুঁটি ধরে নিয়ে এনে ফেলুন। আমি ও পাপের বোঝা নিয়ে ফিরে যাই। রেণুর সংসারটা বাঁচুক। ওর মুখের দিকে যে চাইতে পারি না।
হীরেনবাবু বিজ্ঞের মতো হেসে বলেছিলেন, ব্যাপারটা যদি অত সহজ হত তা হলে তো কথাই ছিল না, অ্যারেস্ট করতে হলে দুজনকেই করতে হবে। বাইগ্যামির চার্জে।
ফুলদিদা আর ক্ষমা মাসি প্রায় মাস খানেক ছিল। দুজনেই বেশ সরল আর ভালমানুষ গোছের। তারা অষ্টপ্রহর মাকে সান্ত্বনা দিত আর রমা মাসির নিন্দে করত।
কিন্তু রমা মাসির একার দোষ বলে মনে হত না বন্দনার। রমা মাসি তো খারাপ ছিল না। কিন্তু সংসারে বোধহয় অদৃশ্য ভূত কিছু আছে। তারাই ঘাড়ে এসে চাপে কখনও সখনও।
দিদা আর মাসি চলে যাওয়ার পর একদিন কেদারকাকু এসে খবরটা দিলেন, মেঘনাদ বড় আত্মগ্লানির মধ্যে আছে বউঠান। ছেলে মেয়ের জন্য বড় কান্নাকাটি করছে। আপনার কথাও খুব বলছে।
মা খুব শান্ত গলায় বলল, উনি কোথায় আছেন?
প্রথমটায় আমার কোয়াটারেই গিয়ে উঠেছিল। পরে একটা বাসা ঠিক করে উঠে যায়। তবে রোজই আসে। চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। কেন যে এ কাজ করল। সবই ভবিতব্য।
আজ সকালের ঝলমলে রোদে চারদিক যেন ভেসে যাচ্ছে আনন্দে। আজ পুরনো দুঃখের কথা ভাবতে নেই। শুধু সুখ বা দুঃখের সময় বন্দনার মনে হয় এখন বাবা থাকলে কেশ হত। বুকের ভিতরটা টনটন করে তখন।
পায়রারা চক্কর খাচ্ছে মাথার ওপর। এ বাড়ির পোষা পায়রা। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে। আকাশের গায়ে যেন এক অঞ্জলি ফুল।
এরকম কত ঐশ্বর্য দিয়ে যে পৃথিবীটা সাজানো! একটা ফুলের দিকে চেয়ে থাকলেও আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। তাকে দেখতে শেখাত বাবা। বাবার চোখ ছিল কবির মতো। স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকত। বাবা বলত, এ পৃথিবীর রূপের যেন শেষ নেই। জানালা দিয়ে এক ঝলক রোদ এসে পড়েছে, তাতে ঝিরিঝিরি নিমের ছায়া, ভাল করে দেখিস, কী অদ্ভুত সুন্দর। নিবিষ্ট হয়ে নিবিড়ভাবে দেখতে হয়।
বাবা ছিল এক কবির মতো মানুষ, বাবা কি আজও সেরকম আছে? কে জানে। রমা মাসিকে নিয়ে সেই যে চলে গেল বাবা, গেল তো গেলই।
২. বাঁশের সাঁকো
০২.
বাঁশের সাঁকোটার মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল অতীশ। তার মাথায় এক বস্তা বেগুন। সে বি-কম পাশ। দিন চারেক আগে সকালে দৌড়োনোর সময় তার ডান কুঁচকিতে একটা টান ধরেছিল। অন্য কেউ হলে বসে যেত। সে বসেনি। নিজেকে চালু রেখেছে। বসলে তার চলবে না। কিন্তু ব্যথাটা আজও সাতবাতিক আছে। ডান পায়ে বেশি ভর দিতে পারে না। এমন চিড়িক দেয় যে ব্রহ্মরন্ধ্র অবধি টের পাইয়ে ছাড়ে। বেশি ব্যথায় একটা অবশ ভাব হয়, আর মাংসপেশি শক্ত হয়ে গুটলি পাকিয়ে থাকে। এসব নিয়েই চলা।
বাঁশের সাঁকোটা পার হওয়া খুব সহজ নয়। দুখানা বাঁশ পাশাপাশি ফেলা, একধারে বাঁ পাশে। একখানা নড়বড়ে রেলিং। পরান আগেই বলে রেখেছে, ধরার বাঁশটায় বেশি ভর দেবেন না। ওটা শুধু টাল সামলানোর জন্য।
আসার সময়ে ভাবনা হয়নি। তরতর করে পেরিয়ে এসেছে। তখন মাথায় পঁচিশ কেজির বেগুরে বস্তা ছিল না। এখন সেটা টলমল করছে মাথায়। তার ওপর পায়ে হাওয়াই চটি। গত রাত্তিরে বৃষ্টিতে গাঁ-গঞ্জে কাদা ঘুলিয়ে উঠেছে। গোড়ালি অবধি এঁটেল মাটিতে মাখামাখি। জামা প্যান্টের পিছনে, মাথা অবধি হাওয়াই চটির চাঁটিতে ছিটকে উঠেছে কাদা। এখন সেই পিছল হাওয়াই। চটি পায়ে সাঁকো পেরোনোর অগ্নিপরীক্ষা।
পরান পিছনেই। ঘাড়ে শ্বাস ফেলে বলল, আপনি পেরে উঠবেন না। দাঁড়ান, আমার বস্তাটা ওপারে রেখে এসে আপনারটা পার করে দিই।
অতীশ পাল্টা প্রশ্ন করল, তুমি পারলে আমি পারব না কেন?
সবাই কি সব পারে?