মা একদিন মধ্যরাতে ফের বাবাকে ধরল, তোমার কেদার দরে কী হল? টিকিট নিয়ে এল না
হয়তো ভুলে গেছে।
আর কত মিথ্যে কথা বলবে বলো তো?
মিথ্যে কথা বলে বাবা কেন তটস্থ হয়ে পড়ল।
মিথ্যে নয়? কেদার দত্তের কাছে তুমি যাওইনি কখনও।
যাইনি।
ডাইনির পাল্লায় পড়লে মানুষের কি আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে? ও তো তোমাকে খেতে এসেছে। তোমাকে খাবে, এ সংসার উড়িয়ে-পুড়িয়ে খাক করবে।
বাবা চুপ করে রইল। অন্ধকারে বাবার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না বন্দনা। কিন্তু তার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। তার বাবা একজন অসহায় মানুষ। কবির মতো মানুষ।
ঘটনাটা শুরু হয়েছিল এক মধ্যরাতে, মা আর বাবার কথাবার্তা সেদিন ঘুম ভেঙে শুনে ফেলেছিল বন্দনা। সেই ঘটনার মাস দুই বাদে একদিন সত্যিই মাসির টিকিট কাটা হল। বাহার তৈরি হ সঙ্গে যাবে বলে।
তখন সন্ধেবেলা, রাত সাড়ে আটটার ট্রেন ধরতে হবে বলে মাসি কাপড় পরে তৈরি হল। ভাতও খেয়ে নিল। হঠাৎ বাবা মাকে বলল, রেল, তুমি ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এসো।
কেন?
নইলে খারাপ দেখাবে।
দেখাক।
নইলে আমাকে যেতে হয়।
তুমিই যাও।
যাব? তোমার তো ফের সন্দেহ হবে।
সন্দেহ! সন্দেহের কিছু নেই। তোমরা দুজনেই পাপী। যাও তোমার তো চুলকুনি আছে।
কী যে বলো। শুনলে ও কী মনে করবে?
কী আবার মনে করবে? ওর মনে করার ভয় করি নাকি? যা সত্যি তাই বলছি।
বাবা একটু ইতস্তত করে বলল, চলেই তো যাচ্ছে। সব ভুলে যাও। বড় সামান্য কারণেই এত কাণ্ড হয়ে গেল।
আমার কাছে কারণ সামান্য নয়।
বাবা হতাশ হয়ে বলল, তুলে দিয়ে আসি। নইলে কথা থাকবে।
যাও, কিন্তু আবার ট্রেনে চড়ে বোসোনা। তোমার যা অবস্থা দেখছি।
এইসব ঠেস-দেওয়া কথার পরও কিন্তু বাবা গিয়েছিল স্টেশনে। গিয়েছিল, কিন্তু ফেরেনি, আজও ফেরেনি।
রাত নটার পর বাহাদুর ফিরে এসে বলল, দিদিমণি তো হাওয়া।
মা চেঁচিয়ে উঠে বলল, তার মানে?
কিছু বুঝলাম না।
কী বুঝলে না?
গাড়িতে ওঠার পর বাবু আমাকে বললেন, ওরে রাস্তার খাবার দিতে ভুলে গেছে একটা পাউরুটি নিয়ে আয় দিদিমণির জন্য, আমি পাঁউরুটি আনতে গেছি, এক মিনিট হবে, এসে দেখি দিদিমণি নেই, বাবুও নেই। সুটকেসও নেই। একজন প্যাসেনজার বলল, ওরা পিছনের দরজা দিয়ে নেমে গেছে।
সে কী?
আমি একটু ভাবনা করে নেমে পড়লাম, ভাবলাম খবরটা দিয়ে যাই।
মা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে থরথরিয়ে কেঁপে উবু হয়ে বসে পড়ল, শুধু বলল, এও হয়? হতে পারে?
বাহাদুর তার মালপত্র রেখে মদনকাকাকে নিয়ে ফের স্টেশন-চত্বর খুঁজতে গেল, যদি কোথাও পাওয়া যায়।
চিরকুটটা পাওয়া গেল শোওয়ার ঘরের কাশ্মীরি গোল টেবিলটার ওপর। একটা কাঁচের গেলাসে চাপা দেওয়া একসারসাইজ বুকের একটা রুল-টানা পাতায় শুধু লেখা, আমাদের খুঁজো না, পাবে না।
কিন্তু ঘটনার প্রথম ধাক্কাটা সামলে মা যখন উঠে দাঁড়াল তখন বাঘিনীর মতো তার চেহারা, দাঁতে দাঁত পিষে শুধু বলতে লাগল, এত সহজে ছেড়ে দেব? এত সহজে ভেঙে দিয়ে যাবে আমার। সংসার?
সুতরাং পাড়া প্রতিবেশী এল, পুলিশ এল, দু-একজন নেতাও এলেন। তাঁদের মধ্যে সুবিমল স্যার। প্রদীপের মৃত্যুর পর থেকে সুবিমল স্যারকে একদমই পছন্দ করত না মা, নাম শুনলেই রেগে যেত। কিন্তু এ ঘটনার পর সুবিমল স্যার খুবই কাজে লাগলেন। তাঁর দলের ছেলেরা সারা শহরে তোলপাড় করে বেড়াল দুজনের খোঁজে। সারা শহরে ঢি ঢি। তারা ভাই বোন স্কুলে অবধি যেতে পারত না লজ্জায়।
সেইসব দিন খুব মনে আছে বন্দনার। বাইরের এইসব ঘটনাবলি তাকে আরও ভয় পাইয়ে দিত, সে গুটিয়ে যেত নিজের মধ্যে। বুকটা কী ভীষণ টনটন করত বাবার জন্য। তার ভাল মানুষ, কবির মতো বাবার এ কী হল? এখন সে কী করে থাকবে বাবা ছাড়া?
মাঝরাতে একদিন ঘুম থেকে তাকে ঠেলে তুলে মা বলল, রাক্ষুসি, ঘুমের মধ্যে কার নাম করছিলি?
অবাক বন্দনা ভয় খেয়ে বলল, কার মা?
খবরদার ও নাম আর উচ্চারণ করবি না, বাবা! কীসের বাবা রে? জন্ম দিলেই বুঝি বাবা হয়? এত সহজ!
এই বকুনির অর্থ কিছুই বোঝেনি সে। শুধু বুঝল সে ঘুমের মধ্যে বাবাকে ডেকেছিল।
মাসির কথাও কি মনে হত না তার? খুব হত। দুঃখী, বোগা মেয়েটা সেই যে সকালে মায়ের তাড়া খেয়ে গিয়ে গোগ্রাসে রুটি খাচ্ছিল, সেই দৃশ্য কি ভোলা যায়? মাসিকে তো একসময়ে সে ভীষণ ভালবাসত। দু একদিন গল্প করতে করতে এক খাটে ঘুমিয়ে পড়েছে প্রথম প্রথম। মাসির প্রথম আসার পর কী আনন্দেই তাদের কাটত। এই মস্ত বাড়িটায় একজন নতুন এলে তাদের এমনিতেই ভাল লাগে। তার ওপর মাসির মতো অমন মিশুকে মিষ্টি মানুষ। তারপর কী যে হয়ে গেল।
আজ অবধি মাসিকে পুরোপুরি ঘেন্না করতে পারে না বন্দনা। কিছুতেই পারে না। আর বাবাকে সে.আজও অন্ধের মতো ভালবাসে। তবু দুজনকে একসঙ্গে ভাবলে তার কষ্ট হয়। কেন এরকম করল বাবা?
দিন সাতেক বাদে রমা মাসির মা এল আর এক মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। বাবা আসতে পারল না, তার নাকি ছুটি নেই। সেই দিদা এসে অনেক কান্নাকাটি করল, রেণু, তোর সর্বনাশ করল আমার পেটের মেয়ে। গলায় দড়ি দিলেও কি এ জ্বালা জুড়োবে?
মা কাঁদতে কাঁদতে আর ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, সে শুধু আমার সর্বনাশই করেনি ফুলপিসি, একটা গোটা সংসার ছারখার করে দিয়ে গেছে। আমার ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল। বাইরের সমাজে মুখ দেখানোর উপায় রইল না। কেন যে সর্বনাশীকে এ বাড়িতে পাঠাতে গেলে!