সুকুমারকে এ-বাড়ির সবাই জানে। সোমনাথের সঙ্গে সে একই কলেজে পড়েছে। সোমনাথের মতোই সেকেন্ড ডিভিসনে পাস করেছিল সুকুমার। তারপর সোমনাথের মতোই সাধারণভাবে বি-এ পাস করেছে। সুকুমার হয়তো আর একটু ভালো করতে পারতো কিন্তু পরীক্ষার ঠিক আগে মায়ের ভীষণ অসুখ করলো। এই যায় এই যায় অবস্থা—ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত দিয়ে, সারারাত জেগে রোগীর সেবা করে সুকুমারকে পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল। মেজবোন কণা বকাবকি না করলে সুকুমারের পরীক্ষাই দেওয়া হতো না।
চায়ের কাপ নামিয়ে কমলা বউদি জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছো, সুকুমার?”
এক গাল হেসে সুকুমার উত্তর দিলো, “খারাপ নই, বউদি। সামনে অনেকগুলো চাকরির চান্স আসছে।”
কমলা বউদি সস্নেহে বললেন, “চা বোধহয় খুব কড়া হয়নি; তুমি তো আবার পাতলা চা পছন্দ করো না।”
সুকুমার দেখলো চায়ের সঙ্গে বউদি দুখানা বিস্কুটও দিয়েছেন। হাত দুটো দ্রুত ঘষে সুকুমার বললো, “বউদি, ভগবান যদি আপনাকে ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের পার্সোনেল ম্যানেজার করতেন!”
বুঝতে না পেরে সোমনাথ প্রতিবাদ করলো। “কেন রে? বউদি কোন দুঃখে ব্যাঙ্কের চাকর হতে যাবে?”
সরল মনে সুকুমার বললে, “বউদির একটু কষ্ট হতো স্বীকার করছি। কিন্তু তোর এবং আমার একটা হিল্লে হয়ে যেতো। দুজনে বউদির অফিস ঘরে ঢুকে পড়লে বউদি শুধু আদর করে চা খাইয়ে ছাড়তেন না-সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটাও দিয়ে দিতেন।”
সুকুমারের কথা শুনে কমলাও হেসে ফেললো। দুই বেচারার মখের দিকে তাকিয়ে কমলার মনে হলো ওরকম একটা বড় পোস্ট থাকলে মন্দ হতো না। অন্তত এদের মখে একটু হাসি ফোটানো যেতো।
সুকুমার কিন্তু চাকরির আশা এখনও ছাড়ে নি। সব সময় ভাবে, এবারে একটা কিছু, সুযোগ নিশ্চয় এসে যাবে। চা খেতে-খেতে সে সোমনাথকে বললো, “আর ক’টা দিন। তারপর হয়তো দেশে বেকার বলে কিছু থাকবেই না।”
সোমনাথ নিজেও এক সময় এই ধরনের কথা বিশ্বাস করতো। এখন ভরসা কমেছে।
সুকুমার বললো, “একেবারে ভিতরের খবর। রেল এবং পোস্টাপিসে দু’ হাজার নতুন পোস্ট তৈরি হচ্ছে। মাইনেও খুব ভাল–টু হানড্রেড টেন। সেই সঙ্গে হাউস রেন্ট, ডি-এ। তারপর যদি কলকাতায় পোস্টিং করিয়ে নিতে পারি তাহলে তো মার দিয়া কেল্লা। ঘরের খেয়ে পুরো মাইনেটা নিয়ে চলে আসবো অথচ ক্যালকাটা কমপেনসেটরি অ্যালাউন্স পাবো মোটা টাকা।”
সোমনাথ এবার একটু উৎসাহ পেলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘কিন্তু এই ক্যালকাটা কমপেনসেটরি’ ব্যাপারটা কী রে?
সুকুমার হেসে ফেললো। “ওরে মূর্খ, তোকে আর কী বোঝাবো? চাকরি করবার জন্যে কলকাতায় থাকতে তো আমাদের কষ্ট হবে—তাই মাইনের ওপর ক্ষতিপূরণ ভাতা পাওয়া যাবে।”
এই ব্যাপারটা সোমনাথের জানা ছিল না। “বারে! চিরকালই তো তুই আর আমি কলকাতায় আছি-এর জন্যে ক্ষতিপূরণ কী?” সোমনাথ বোকার মতো জিজ্ঞেস করে। কাল্পনিক চাকরির সুখ-সুবিধে এবং মাইনে সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করতে ওদের দুজনেরই ভালো লাগে।
সুকুমার বিরক্ত হয়ে বললো, “বেশ বাবা, তোর যখন এতোই আপত্তি, চাকরিতে ঢুকে তুই অ্যালাউন্স নিস না।”
এবার দুজনেই হেসে ফেললো। একসঙ্গে দুজনেই যেন হঠাৎ বুঝতে পারলো ওরা জেগে স্বপ্ন দেখছে, এমনভাবে কথা বলছে যেন চাকরিটা ওদের পকেটে।
সারাদিন টো-টো করে সমস্ত শহর চষে বেড়ায় সুকুমার। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ, রাইটার্স বিল্ডিংস, ক্যালকাটা কর্পোরেশন, বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, কারখানা, অফিস কিছুই বাদ দেয় না। তাছাড়া বিভিন্ন দলের বেশ কয়েকজন এম-এল-এ এবং দুজন কর্পোরেশন কাউনসিলর-এর সঙ্গেও সুকুমার ভাব জমিয়ে এসেছে।
সুকুমার বললো, “কদিন আগে বাবা হঠাৎ আমার ওপর রেগে উঠলেন। ওঁর ধারণা আমি চাকরির জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি না। ভাইবোনদের সামনে চীৎকার করে উঠলেন, হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকলে কোলের ওপর চাকরি ঝপাং করে পড়বে না। সেই থেকে এই ‘ঘুরঘুরে’ পলিসি নিয়েছি। দিব্যি কেটেছি, দুপুরবেলায় বাড়িতে বসে থাকবো না।”
সোমনাথ অজানা আশঙ্কায় চুপ করে রইলো। সুকুমারের সংসারের কথা শুনলে ওর কেমন অস্বস্তি লাগে। যে-সুকুমার দঃখ ভোগ করছে, সে কিন্তু মান-অপমান গায়ে মাখছে না। বেশ সহজভাবে সুকুমার বললো, “আমি ভেবেছিলাম মা আমার দুঃখ বুঝবে। কিন্তু মা-ও সাপোর্ট করলো বাবাকে। আমি ভাবলাম, একবার বলি, কলকাতা শহরে ঘোরাঘুরি করতে গেলেও পয়সা লাগে। যাদবপুর থেকে ডালহৌসি স্কোয়ার তো দুবেলা হেঁটে মারা যায় না।”
সুকুমারের কথাবার্তায় কিন্তু কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। অপমান ও দুঃখের বোঝাটা বেশ সহজভাবেই মাথায় তুলে নিয়েছে।
সুকুমারের সান্নিধ্য আজকাল সোমনাথের বেশ ভালো লাগে। কলেজে একসঙ্গে পড়েছে, তখন কিন্তু তেমন আলাপ ছিল না। সুকুমারকে সে তেমন পছন্দ করতো না–নিজের পরিচিত কয়েকজন বন্ধু ও বান্ধবীদের নিয়েই সোমনাথের সময় কেটে যেতো। চাকরি-বাকরির দুঃস্বপ্ন যে এমনভাবে জীবনটাকে গ্রাস করবে তা সোমনাথ তখনও কল্পনা করতে পারে নি।
কিন্তু বি-এ পরীক্ষায় পাসের পর আড়াই বছর আগে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের লাইনে দুই সহপাঠীতে দেখা হয়ে গেলো। সাড়ে-পাঁচ ঘণ্টা ধরে দুজনে একই লাইনে দাঁড়িয়েছিল। বাদাম ভাজা কিনে সুকুমার ভাগ দিয়েছিল সোমনাথকে। একটু পরে ভাঁড়ের চা কিনে সোমনাথ বন্ধুকে খাইয়েছিল। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সোমনাথের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। এই ধরনের অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয় নি। সোমনাথের মনের অবস্থা সুকুমার সহজেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সুকুমারের মনে তখন অনেক আশা। বন্ধুকে উৎসাহ দিয়ে সে বলেছিল, “ভাবিস না, সোমনাথ। দেশের এই অবস্থা চিরকাল থাকতে পারে না। চাকরিবাকরি আমাদের একটা হবেই।”