সোমনাথ দেখলো অরবিন্দের হাতে গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের প্যাকেট। “খাবে নাকি একটা?” অরবিন্দ প্যাকেট এগিয়ে দিলো।
সোমনাথ সিগারেট নিলো না। অরবিন্দ হেসে ফেললো। “তুমি এখনও সেই ভালো ছেলে রয়ে গেলে? মেয়েদের দিকে তাকালে না, সিগারেট খেলে না, অশ্লীল ম্যাগাজিন পড়ো না।”
অরবিন্দ এবার জিজ্ঞেস করে বসলো, “তুমি কী করছো?”
সোমনাথ অত্যন্ত লজ্জা বোধ করছে। দিতে দিতে চাকরির অ্যাপ্লিকেশন লেখা ছাড় সে যে আর কিছুই করছে না তা জানাতে মাথা কাটা যাচ্ছে সোমনাথের। কোনো রকমে আমতা আমতা করে বলতে যাচ্ছিল, “দেখা যাক, ধীরে সুস্থে কী করা যায়।”
কিন্তু তার আগেই অরবিন্দ বললো, “চেপে রাখবার চেষ্টা করছো কেন ভাই? শুনলাম, ফরেনে যাবার প্রোগ্রাম করে ফেলেছো? তা ভাই, ভালোই করছো। আমরা এই ভোর সাড়ে সাতটার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে, পাঁচ বছর কারখানায় তেল-কালি মেখে বেস্ট-কী—রিচার্ডসের জুনিয়র অফিসার হবো। আর তুমি তিন বছর পরে ফরেন থেকে ফিরে এসে হয়তো বেস্ট-কীনেই আমার বস হয়ে বসবে।”
ফরেন যাবার কথাটা যদিও পুরোপুরি মিথ্যে, তবও সোমনাথের মন্দ লাগছে না। “কে বললো তোমাকে?” সোমনাথ প্রশ্ন করলো।
“নাম বলতে পারবো না–তবে তোমারই কোনো ফ্রেন্ড,” অরবিন্দ উত্তর দিলো।
“গার্ল ফ্রেন্ডও হতে পারে,” এই বলে অরবিন্দ এবার রহস্যজনকভাবে হাসলো। “বেশ গোপনে কাজটা সেরে ফেলবার চেষ্টা করছো তুমি,” বললো অরবিন্দ।
দূর থেকে বেস্ট-কীন-রিচার্ডসের ঝকঝকে মিনিবাস আসতে দেখে অরবিন্দ বললো, “তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। দু-একদিনের মধ্যেই তোমার সঙ্গে দেখা করবার প্রয়োজন হবে। সামনের রবিবারে বিকেলটা ফ্রি রেখো। কারণটা যথা সময়ে জানতে পারবে। তোমার বাড়ির নম্বর?”
সোমনাথ বাড়ির নম্বরটা বলে দিলো। অরবিন্দ ততক্ষণে ছুটে গিয়ে মিনিবাস ধরে ফেলেছে।
বাজারের থলিটা বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে বসে সোমনাথ ভাবছিল ফরেন যেতে পারে শুনে অরবিন্দ সেন বেশ খাতির করে কথা বললো। ওর বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের বড় অফিসার। ছোট একটা গাড়ি ড্রাইভ করে কলেজে আসতো। সোমনাথের সঙ্গে তেমনভাবে মিশতো না অরবিন্দ। কিন্তু বিদেশে যাবার এই গল্পটা কে বানালো? দু-একজন পরিচিত মহিলার মুখ মনে পড়ে গেলো। কয়েকটা ছবি সরাবার পর হঠাৎ তপতীর মুখটাও চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তপতীই হয়তো অস্বস্তি এড়াবার জন্য রত্নাকে গল্পটা বলেছে। কলেজে রত্নার সঙ্গে তপতীর খুব ভাব ছিল। অরবিন্দ যে রত্নর সঙ্গে জমিয়ে প্রেম করেছে এ-খবর কারুর অজানা নয়।
কিন্তু তপতী জেনেশুনে কেন এইভাবে বন্ধু মহলে সোমনাথকে অপ্রস্তুত করতে যাবে? সোমনাথ আরও কিছু ভাবতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার চিন্তায় বাধা পড়লো। বাইরে ইলেকট্রিক কলিং বেল বাজছে।
কমলা বউদি খবর দিলেন সুকুমার এসেছে। রোগা, কালো, বেশ লম্বা, মিষ্টি স্বভাবের এই ছেলেটি সম্পর্কে কমলা বউদির একটু দুর্বলতা আছে। ও বেচারাও বেকার। ওর উজ্জ্বল অথচ অসহায় চোখ দুটোর দিকে তাকালে মায়া হয় কমলার।
বাইরের ঘরে সোমনাথ ঢুকতেই সুকুমার বললো, “তোর হলো কী? সাড়ে-আটটা বেজে গেছে, এখনও বিছানার মায়া কাটাতে পারিসনি?”
সোমনাথ যে ইতিমধ্যে বাজার-হাট সেরে ফেলেছে তা চেপে গেলো। বললো, “বেকারের কী আর করবার আছে বল?”
“ফের আবার ওই অশ্লীল কথাটা মুখে আনলি। তোকে বলেছি না, ‘বিধবার’ মতো ‘বেকার’ কথাটা আমার খুব খারাপ লাগে। আমরা চাকরি খুঁজছি, সুতরাং আমাদের চাকুরী-প্রার্থী বলতে পারিস।”
“তুই যে আবার প্রথম ভাগের গোপাল হবার পরামর্শ দিচ্ছিস-কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া, যেকারকে বেকার বলিও না,” সোমনাথ মন্তব্য করলো।
সুকুমার বললো, “দাঁড়া মাইরি। কড়া রোদ্দরে যাদবপুর কলোনি থেকে হাঁটতে হাঁটতে এই যোধপুর পার্কে এসেছি। গলা শুকিয়ে গেছে, একটু খাবার জল পেলে মন্দ হতো না।”
কমলা বউদি ঠাণ্ডা জল নিয়ে এলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “চা খাবে তো, সুকুমার?”
সুকুমার খুব খুশী হলো। বললে, “বউদি, যুগ যুগ জিও।”
বউদি চলে যেতে সুকুমার বন্ধুকে বললো, “তুই মাইরি খুব লাকি। যখন তখন চায়ের অর্ডার দেবার সিস্টেম আমাদের বাড়িতে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বাই অর্ডার অফ দি হোম বোর্ড।” সুকুমারের কিন্তু সেজন্যে কোনো অভিমান নেই। ফিক করে হেসে, বন্ধুকে জানিয়ে দিলো, দাঁড়া, একখানা চাকরি যোগাড় করি। তারপর বাড়িতে আমূল বিপ্লব এনে ছাড়বো। যখন খুশী চায়ের জন্যে একটা ইলেকট্রিক হিটার কিনে ফেলবো। চা চিনি দুধের খরচ পেলে বাড়িতে কেউ আর রাগ করবে না।”
সুকুমারটা সত্যিই অভাগা। ওর জন্যে সোমনাথেরও কষ্ট হয়। শুনেছে, যাদবপরে একটা টালির ছাদের কাঁচা বাড়িতে থাকে। ওর তিনটে আইবুড়ো বোন! টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছে না। গত বছর সুকুমারের বাবার রিটায়ার হবার কথা ছিল। সায়েবের হাতে-পায়ে ধরে ভদ্রলোক এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তিন মাস পয়েই চাকরি শেষ হবে। তারপর ওদের কী যে হবে। সুকুমারই বড়। আরও দুটো ভাই ছোট, নীচু ক্লাসে পড়ে। এই ক’মাসে একটা কাজ যোগাড় না হলে কেলেঙ্কারি। বাবার পেনসন নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা ধার নেওয়া আছে। তার ওপর কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে কিছু দেনা আছে বাবার। বড়দির বিয়ে দিতে গিয়ে সেবার ধার না করে উপায় ছিল না। এ-সব বাদ দিয়ে সুকুমারের বাবা হয়তো হাজার ছয়েক টাকা পাবেন। তিনি ভাবছেন তিন ভাগ করে তিন মেয়ের নামে দু’হ্যজার করে লিখে দেবেন। সুকুমারের বাবা অবশ্য জানেন, দু’হাজার টাকায় আজকাল বস্তির ঝিদেরও বিয়ে হয় না। কিন্তু মেয়েরা যেন না ভাবে, বাবা তাদের জন্য কিছুই করেননি।