আমার তরুণ বন্ধুর সাহায্যে নগর কলকাতার এক নতুন দিক আমার চোখের সামনে উদ্ঘাটিত হয়েছিল। এই জগতে পয়সার বিনিময়ে মা তুলে দেয় মেয়েকে, ভাই নিয়ে আসে বোনকে, স্বামী এগিয়ে দেয় স্ত্রীকে। মিসেস বিশ্বাস এবং তাঁর দুই মেয়ের বিজনেসের যে ছবি আঁকা হয়েছে তা মোটেই কল্পনাপ্রসূত নয়। লোভের এই কলুষিত জগতে খদ্দেরের অঙ্কশায়িনী কন্যার আর কতক্ষণ দেরি হবে তা জানবার জন্যে মা নির্দ্বিধায় দরজার ফুটো দিয়ে ওদের দেখে আসেন এবং শান্তভাবে ঘোষণা করেন, “আর দেরি হবে না, টোকা দিয়ে এসেছি, আপনারা বসুন। আমার এই মেয়েটার ঐ দোষ! কাস্টমারকে ঝটপট খুশী করে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারে না। বড় সময় নষ্ট করে।”
অভিজাত সায়েব পাড়ায় মিসেস চক্রবর্তী, মিসেস বিশ্বাসের দুই কন্যা রুমুঝুমু, মিসেস গাঙ্গুলী এবং চরণদাসের ‘টেলিফোন অপ্রেটিং স্কুলের ছাত্রী’ ছাড়াও আরও অনেকের দুর্বিসহ অপমান ও লজ্জার কাহিনী এই সময় জানবার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মিসেস সিনহা। বাইরে পরিচয় ইনসিওরেন্স এজেন্ট। কিন্তু আসলে মিসেস গাঙ্গুলীর সমব্যবসায়িনী। এই মহিলার জীবন বড়ই দুঃখের, এর কথা কোনো এক সময় লেখার ইচ্ছে আছে।
উপন্যাসের সমস্ত উপাদান বিভিন্ন মহল থেকে তিলে তিলে সংগ্রহ করে অবশেষে জন-অরণ্য লিখতে বসেছিলাম। সমকালের এই অপ্রিয় কাহিনী সকলের ভালো লাগবে কিনা সে-বিষয়ে মনে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য একটাই ছিল। আমাদের এই যুগে বাংলার কর্মহীন অসহায় যুবক-যুবতীদের ওপর যে চরম অপমান ও লাঞ্ছনা চলছে উপন্যাসের মাধ্যমে তার একটা নির্ভরযোগ্য চিত্র ভবিষ্যতের বাঙালীদের জন্যে রেখে যাওয়া; আর সেই সঙ্গে এদেশের ছেলেদের এবং তাদের বাবা-মায়েদের মনে করিয়ে দেওয়া যে বেকার সমস্যা সমাধানের জরুরী চেষ্টা না হলে আমাদের সমাজ ও ব্যক্তি-জীবনের বুনিয়াদ ধ্বসে পড়বে।
উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছে এ-কথা অবশ্যই বলা যায় না। কিন্তু অনেকে এই বই পড়ে বিচলিত হয়েছেন। এই ডিসটাবশড্ মানসিক অবস্থায় কেউ-কেউ অভিযোগ করেছেন, এই উপন্যাসের মধ্যে শুধুই নিরাশা, কোনো আশার আলো দেখানোর চেষ্টা হয়নি। তাঁদের প্রশ্ন ‘জন-অরণ্য পড়ে কার কী উপকার হবে?’ আমার বিনীত উত্তর, দীর্ঘ দিনের ঘুম ভাঙানোর জন্যেই তো এই উপন্যাসের সৃষ্টি এবং নিরাশার নিচ্ছিদ্র অন্ধকার থেকেই তো অবশেষে আশার আলো বেরিয়ে আসবে। এই উপন্যাস পড়ে কারও কোনো উপকার হবে কিনা বলা শক্ত, কিন্তু সত্যকে তার স্বরূপে প্রকাশিত হতে দিলে কারোও কোনো ক্ষতি হয় না। এই মুহূর্তে এর থেকে বেশি তো কিছু জানা নেই আমার।
পাণ্ডুলিপিতে এই উপন্যাস পড়ে আমার একান্ত আপনজন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “বড্ড অপ্রিয় বিষয়ে কাজ করলে। লেখাটা শেষ পর্যন্ত কী হবে কে জানে।”
আমার মনেও যে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল না এমন নয়। তবু একটা সান্ত্বনা ছিল। বাংলার ঘরে ঘরে অসহায় সুকুমার ও সোমনাথরা তিলে তিলে ধংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, এদের সঙ্গে সঙ্গে অভাগিনী কণারাও সর্বনাশের অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে, সমকালের লেখক হিসেবে এদের সম্বন্ধে স্বদেশবাসীকে অবহিত করবার দায়িত্ব আমি অস্বীকার করিনি। অপ্রিয় ভাষণের ভয়ে সত্য থেকে মুখ সরিয়ে নিইনি।
বিদেশ থেকে বহু চেষ্টায় বিপ্লবী লেখক ফ্যাননের একখানা বই পেয়েছিলাম। সেই বইয়ের মুখবন্ধে ফরাসী মানব সাতর জ্বালাময়ী ভাষায় লিখেছিলেন, “হে আমার দেশবাসিগণ, আমি স্বীকার করতে রাজী আছি, তোমরা অনেক কিছুরই খবরাখবর রাখে না। কিন্তু এই বই পড়ার পর তোমরা বলতে পারবে না, নির্লজ্জ শোষণ এবং অন্যায়-অবিচারের সংবাদ তোমাদের জানানো হয়নি। হে আমার দেশবাসিগণ, তোমরা অবহিত হও।” উপন্যাসের প্রথম পাতায় সাতরের মহামূল্যবান সাবধানবাণীটি আবার পড়তে অনুরোধ জানাই।
দেশ পত্রিকায় জন-অরণ্য প্রথম প্রকাশিত হবার দিন আমি একটু দেরিতে বাড়ি ফিরেছিলাম। স্ত্রী বললেন, “তোমার উপন্যাসের প্রথম পাঠক সত্যজিৎ রায় ফোন করেছিলেন। যত রাতেই হোক, তুমি ফিরলেই যোগাযোগ করতে বলেছেন।”
পরের দিন ভোরে শুনলাম দুটি ছেলে বরানগর থেকে দেখা করতে এসেছে। ছেলে দুটি বললো, “আমরা গতকালই আসতাম। গতকাল বহু চেষ্টা করেও রাত আটটার আগে আপনার ঠিকানা যোগাড় করতে পারিনি। আমরা দুই বেকার বন্ধু—অনেকটা আপনার সোমনাথ ও সুকুমারের মতো। আমরা আপনার কাছ থেকে সুধন্যবাবুর জামাই—যিনি কানাডায় থাকেন তাঁর ঠিকানা নিতে এসেছি। এদেশে তো কিছু হবে না, বিদেশে পালিয়ে গিয়ে দেখি।” জন-অরণ্যর সুধন্যবাবু এবং তাঁর কানাড়াবাসী জামাই নিতান্তই কাল্পনিক চরিত্র কিন্তু ছেলে দুটো আমাকে বিশ্বাস করলো না। ক্ষমা চাইলাম তাদের কাছ থেকে। বিষণ্ণ বদনে বিদায় নেবার আগে তারা সজল চোখে বললো, “জন-অরণ্য উপন্যাসের একটা লাইনও যে বানানো নয় তা বোঝবার মতো বিদ্যে আমাদেরও আছে শংকরবাবু। আপনি সুধন্যবাবুর জামাইয়ের ঠিকানা দেবেন না তাই বলুন।”
সত্যজিৎ রায় জন-অরণ্য চলচ্চিত্রায়িত করবার কথা ভাবছেন জেনে বিগত রাত্রে যতটা আনন্দিত হয়েছিলাম, আজ সকালে ঠিক ততটাই দুঃখ হলো। দেশের লক্ষ লক্ষ বিপন্ন ছেলেমেয়েদের হৃদয়ে আশার আলোক জ্বালিয়ে দেবার ক্ষমতা আমার নেই ভেবে লজ্জায় মাথা নিচু করে অসহায়ভাবে বসে রইলাম।