সেই শুরু। বিজনেসে নেমে পড়বার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই সময় পার্কেচক্রে এক মাদ্রাজি ছোকরার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেলো—মিস্টার ঘোষ নামে এক বাঙালী ফাইনানসিয়ারের সহযোগিতায় তিনি ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেট তৈরির ব্যবসা খুলেছেন। আমি ওই কোম্পানির এজেন্ট।
বাস্কেট তৈরির সেই কারখানা এক আজব জায়গায়। তার ঝুড়িগুলো রং হতো মধ্য কলকাতার এক পুরানো বাড়িতে। এই রং করতেন কয়েকজন সিন্ধি এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা-সন্ধ্যেবেলায় যাঁদের অন্য পেশা ছিল। দেহবিয় করেও দেহধারণ কঠিন হয়ে পড়েছিল বলে এঁরা এই পার্টটাইম কুটিরশিল্পে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তখন আমার কম বয়স, কলকাতার অন্ধকার জীবনযাত্রা সম্পর্কে কিছুই জানি না। এইসব স্নেহশীলা মহিলাদের সাক্ষাৎ-সংস্পর্শে এসে অভিজ্ঞতার এক নতুন দিগন্ত আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হলো।
অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসায়ে নেমে আপিসপাড়ার যে-জীবনকে দেখলাম তার কিছুটা ‘চৌরঙ্গী’র মুখবন্ধে নিবেদন করেছি। অনেক কোম্পানির কোট-প্যান্ট-চশমাপরা ক্রেতা গোপনে বাড়তি কমিশন চাইতেন, হাতে কিছু গুঁজে না দিলে পাঁচ-ছ’টাকার অর্ডারও তাঁরা হাতছাড়া করতেন না। মানুষের এই অরণ্যে পথ হারিয়ে মানুষ সম্বন্ধে যখন আশা ছাড়তে বসেছিলাম তখন ডালহৌসি-পাড়ার সাহেবী আপিসে এক দারোয়ানজীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। দারোয়ানজী সস্নেহে আমার কাছ থেকে কয়েকটা ঝুড়ি কিনলেন, সঙ্গে সঙ্গে পেমেন্টের ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি ভাবলাম দারোয়ানজীর এই স্পেশাল আগ্রহের স্পেশাল কারণ আছে। বিক্রির টাকাটা হাতে পেয়ে দারোয়ানজীকে কমিশন দিতে গেলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, “ছি ছি! ভেবেছো কি? তোমার কাছ থেকে পয়সা নেবার জন্যে এই কাজ করেছি আমি! ঘামে ভেজা তোমার অন্ধকার মুখখানা দেখে আমার কষ্ট হয়েছিল, তাই তোমাকে সাহায্য করেছি।”
দারোয়ানজী সেদিন আমাকে মাটির ভাঁড়ে চা খাইয়েছিলেন। নানা মূল্যবান উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।”
জীবনের এক সঙ্কটমুহূর্তে ডালহৌসি-পাড়ার অশিক্ষিত দারোয়ান আমাকে বাঁচিয়েছিল—আমি হেরে যেতে যেতে হারলাম না।
আমার মনের সেই অনুভূতি আজও নিঃশেষ হয়নি—মানুষকে আমি কিছুতেই পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারি না। কিন্তু ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেট হাতে দোকানে দোকানে, আপিসে আপিসে ঘরে মানুষের নির্লজ্জ নগ্নরূপ দেখেছি। দু-একটা জায়গায় ঝুড়ি জমা দিয়ে একটা পয়সাও আদায় করতে পারিনি। এক সপ্তাহ পায়ে হেঁটে আপিসপাড়ায় এসে এবং টিফিন না করে আমাকে সেই ক্ষতির খেসারৎ দিতে হয়েছে। ক্যানিং স্ট্রীটের একটা দোকানে ছ’টা ঝুড়ি দিয়েছিলাম—অন্তত তিরিশবার গিয়েও পয়সা অথবা ঝুড়ি কোনোটাই উদ্ধার করতে পারিনি। তবু যে পুরোপুরি হতাশ হইনি, তার কারণ মধ্যদিনে মধ্য-কলকাতার বান্ধবীরা। তাঁরা আমাকে উৎসাহ দিতেন। বলতেন, দেহের ব্যবসাতেও অনেক সময় টাকা মারা যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সুযোগ আসে যখন সমস্ত লোকসান সুদসমেত উসুল হয়ে যায়।
আমারও সামনে একদিন তেমন সম্ভাবনার ইঙ্গিত ঝলমল করে উঠলো। এক ভদ্রলোক বললেন, তিনি ডিসপোজাল থেকে খুব সস্তাদরে কিছু স্টীল বেলিং হুফ কিনেছেন। দাম বললেন এবং জানালেন, এর ওপর চড়িয়ে আমি যত দামে মাল বিক্রি করতে পারবো সবটাই আমার প্রফিট।
এইসব বেলিং হুফ কাপড়ের কল এবং জুট মিলে লাগে। কয়েকদিন খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, ঠিক মতো পার্টি যোগাড় করতে পারলে বেশ কয়েক হাজার টাকা লাভের সম্ভাবনা আছে। বিজনেসে বড়লোক হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনেক আপিসে ঘুরলাম। কিন্তু কোনো ফল হলো না। শেষে এক বন্ধ ভদ্রলোক আমার ওপর দয়াপরবশ হয়ে বললেন, “এইভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য হয় না ভাই—বড় বড় কারখানায় আপনার জানশোনা কোনো অফিসার নেই? ওই রকম কারুর মাধ্যমে পারচেজ অফিসারদের নরম করবার চেষ্টা করুন।”
অফিসারকে নরম করবার ব্যাপারটা তখনও বুঝে উঠতে পারিনি। একজন পরিচিত ভদ্রলোকের সাহায্যে এক জুট মিলে কিছুটা এগোলাম। জিনিসের নমুনা দিলাম। দামও যে সস্তা জানিয়ে দিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না। পরিচিত ভদ্রলোক আমার দুঃখে কষ্ট পেয়ে বললেন, “পারচেজ অফিসার মালিকের আত্মীয়-ওরা নিজেদের খেয়ালখুশী মতো চলে, ওদের সাতখুন মাপ।”
ভদ্রলোকের কাছে যাতায়াত করে জুতোর হাফসোল খুইয়ে ফেলেছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু করা গেলো না। উনি কেন যে আমাকে অর্ডার দিলেন না তাও অজানা রয়ে গেলো।
শেষ পর্যন্ত ছোটখাট একটা চাকরি যোগাড় হয়ে যাওয়ায় ব্যবসার লাইন ছেড়ে বিজনেসে বড়লোক হবার স্বপ্নটা চিরদিনের মতো বিসর্জন দিয়েছি। এমন সময় একদিন মধ্য-কলকাতার সেই বাড়িতে গিয়েছি, কিছু হিসেব-পত্তর বাকি ছিল। তখন দুপুর তিনটে। রোজী নামে এক খ্রীষ্টান দেহপসারিণীর সঙ্গে আমার খুব আলাপ ছিল। তার ঘরে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেলাম—আমার পরিচিত পারচেজ অফিসার সেখানে বসেই দুদণ্ডের আনন্দ উপভোগ করছেন। মিনিট দশেকের মধ্যেই ভদ্রলোক বিদায় নিলেন।
পরে শুনেছি, আমাদের কোম্পানির মাদ্রাজি যুবকের বিশিষ্ট অতিথি হিসাবেই ভদ্রলোক রোজীর বিজন কক্ষে এসেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সেই বেলিং হুফ যা আমি বেচতে পারিনি তা তিনি রোজীর দেহসান্নিধ্যে সন্তুষ্ট হয়ে চড়া দরে কিনেছেন। রোজী আমার বোকামিতে বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “ইউ আর এ ব্লাডি ফুল। আমাকে আগে বলোনি কেন?”