দেবরের এমন কথা বলার ভঙ্গী কমলা বউদি কোনোদিন দেখেননি। বললেন, “হাত থেকে নোংরার মধ্যে পড়েছিল বুঝি।”
সোমনাথ আবার বললো, “আপনাকে তো বারণ করলাম ঐ কাপড় পরতে।” কমলা অগত্যা কাপড়টা কাচবার জন্যে সরিয়ে রাখলেন।
আরও রাত হয়েছে। অভিজিৎ আসানসোল ফ্যাকটরিতে গিয়েছে—আজ ফিরবে না। সোমনাথ খেতে আসছে না দেখে বলল ওকে ডাকবার জন্যে ঘরে ঢুকে পড়েছিল। ভেবেছিল, সেই সময় অভিনন্দন জানিয়ে নিজের কাপড়টাও চেয়ে নেবে।
কিন্তু মুখ শুকনো করে সে সোমনাথের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দিদির কাছে দ্রুত এসে উদ্বেগের সঙ্গে ফিসফিস করে সে বললো, “দিদি কী ব্যাপার! সোম বালিশে মুখ গুঁজে লুকিয়ে লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।”
কমলার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। বললেন, “নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ওর বোধহয় মায়ের কথা মনে পড়ে গেছে।” বউদি কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, “ওকে লজ্জা দিও না—ওকে কাঁদতে দাও।”
৩৩. জন-অরণ্যের নেপথ্য কাহিনী
কোনো গল্প-উপন্যাস পাঠক-পাঠিকাদের ভালো লাগলে লেখকের যেমন আনন্দ তেমনি নানা অসুবিধে। পথে-ঘাটে, ট্রামে-বাসে, আপিসে-রেস্তরাঁয় পরিচিতজনরা এগিয়ে এসে বলেন, তোমার অমক বইটা পড়লাম–দারণ হয়েছে। ডাকপিওন অপরিচিতজনদের চিঠির ডালি উপহার দিয়ে যায়; সম্পাদক ও প্রকাশকের দপ্তর থেকে রি-ডাইরেকটেড হয়েও অনেক অভিনন্দন-পত্র আসে। এসব অবশ্যই ভালো লাগে। কিন্তু অসুবিধে শুরু হয় যখন উপন্যাসের মূল কাহিনী সম্পর্কে পাঠকের মনে কৌতূহল জমতে থাকে।
তখন প্রশ্ন ওঠে, অমুক কাহিনীটি কী সত্য? কেউ-কেউ ধরে নেন, নির্জলা সত্যকেই গল্পের নামাবলী পরিয়ে লেখকেরা আধুনিক সাহিত্যের আসরে উপস্থাপন করে থাকেন। আর একদল বিরক্তভাবে বলে ওঠেন, “সব ঝুটা হ্যায়—জীবনে এসব কখনই ঘটে না, সস্তা হাততালি এবং জনপ্রিয়তার লোভে বানানো গল্পকে সত্য-সত্য ঢঙে পরিবেশন করে লেখকেরা দেশের সর্বনাশ করেছেন।
জন-অরণ্য উপন্যাস নিয়ে আমাকে এই ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপে পাঠক ও দর্শকের কৌতূহলে ইন্ধন জুগিয়েছে। দেশের বিভিন্ন মহলে কাহিনীর পক্ষে এবং বিপক্ষে বিতর্কের ঝড় উঠেছে।
প্রত্যেক গল্পের পিছনেই একটা গল্প লেখার গল্প থাকে এবং জন-অরণ্য লেখার সেই নেপথ্য কাহিনীটা স্বীকারোক্তি হিসেবে আদায় করবার জন্য অনেকেই আমার উপর চাপ দিয়েছেন। কৌতূহলী পাঠকদের এতোদিন আমি নানা তর্কজালে আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি। বলেছি, “থিয়েটারের সাজঘর দেখলে নাটক দেখবার আকর্ষণ নষ্ট হতে পারে।” কিন্তু সে যুক্তি শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। বিদেশের লেখকরা নাকি গল্প লেখার সাজঘরের গল্পটাও অনেক সময় উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। বিখ্যাত এক সায়েবলেখকের নাম করে জনৈকা পাঠিকা জানালেন, “আপনি তো আর মিস্টার অমুকের থেকে কৃতী লেখক নন? তিনি যখন তাঁর অমুক উপন্যাস রচনার ইতিহাসটা বই-আকারে লিখে ফেলেছেন তখন আপনার আপত্তি কোথায়?”
মহিলার কথায় মনে পড়লো, উপন্যাস রচনার জন্য সংগহীত কাগজপত্র, নোটবই, প্রথম খসড়া ইত্যাদি সম্পর্কে এখন বিদেশে বেশ ঔৎসুক্য সষ্টি হয়েছে। ওয়াশিংটনে পৃথিবীর বহত্তম গ্রন্থাগার লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের পাণ্ডুলিপি বিভাগে এই ধরনের ওয়ার্কিং পেপার সযত্নে সংগ্রহ করা হচ্ছে। ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে ওই গ্রন্থাগারে আমাকে জেমস মিচনারের ‘হাওয়াই’ উপন্যাস সংক্রান্ত ওয়াকিং পেপারস-এর একটা বাক্স সগর্বে দেখানো হয়েছিল।
আমার পাঠিকাকে বলেছিলাম, “আমরা এখনও সায়েব হইনি। পড়াশোনা, অনুসন্ধান, গবেষণা, লেখালেখি, কাটাকাটির পরে শেষপর্যন্ত যে বইটা বেরুলো তাই নিয়েই পাঠকদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তার আগে কী হলো, তা নিয়ে লেখক ছাড়া আর কারুর মাথা-ব্যথ্যর যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।”
পাঠিকা মোটেই একমত হলেন না—সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করে বললেন, “লজ্জা পাবার মতো কিছু, যদি না করে থাকেন, তাহলে কোনো কিছুই গোপন করবেন না।”
এরপর চুপচাপ থাকা বেশ শক্ত। কাতরভাবে নিবেদন করলাম, “এদেশে মূল উপন্যাসটাই লোকে পড়তে চায় না। উপন্যাসটা কীভাবে লেখা হলো সে-বিষয়ে কার মাথা-ব্যথা বলুন?”
মহিলা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, “ওসব ছেলে-ভুলোনো কথায় মেয়ে ভুলতে পারবেন। আপনার জন-অরণ্য লেখার গল্পটা আমরা পড়তে চাই।”
অতএব আমার গত্যন্তর নেই। জন-অরণ্য উপন্যাসের গোড়ার কথা থেকেই শর করতে হয়।
এই উপন্যাস লেখার প্রথম পরিকল্পনা এসেছিল আমার বেকার জীবনে। সে অনেকদিন আগেকার কথা। বাবা হঠাৎ মারা গিয়ে বিরাট সংসারের বোঝা আমার মাথার ওপর চাপিয়েছেন। একটা চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অথচ আফিস অথবা কারখানার কাউকে চিনি না—চাকরি কী করে যোগাড় করতে হয় তাও জানি না। এই অবস্থায় নতুন আপিসে গিয়ে লিফটে চড়তে সাহস পেতাম না—আমার ভয় ছিল লিফটে চড়তে হলে পয়সা দিতে হয়। চাকরির সন্ধানে সারাদিন ঘরে ঘরে কলকাতার আপিসপাড়া সম্বন্ধে আমার মনে বিচিত্র এক ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল। একদিন এক পদস্থ ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে আমাকে বকুনি লাগালেন, “বাঙালীরা কি চাকরি ছাড়া আর কিছু, জানবে না? বিজনেস করুন না?”
“কিসের বিজনেস?” ভদ্রলোক বললেন, “এনিথিং—ফ্রম আলপিন টু এলিফ্যান্ট।”