টোকা পড়তেই গোয়েঙ্কাজী দরজা খুলে দিলেন। কেমন মনোহর প্রশান্ত সৌম্য মুখে তিনি সোমনাথকে ভিতরে আসতে বললেন। শিউলিকে দেখা যাচ্ছে না। সে কোথায় গেলো? এখনও ভিতরের ঘরে শুয়ে আছে নাকি?
সোমনাথের আন্দাজ ঠিক হয়নি। শিউলি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। সমুদ্রের আলোড়নের মতো ফ্লাশের আওয়াজ ভেসে আসছে। শিউলি কারো দিকে তাকাচ্ছে না। সে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। বেচারাকে ক্লান্ত বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে।
কী আশ্চর্য! এই ঘরে শিউলি ছাড়া অন্য কারও চোখে-মুখে লজ্জার আভাস নেই। গোয়েঙ্কাজী শান্তভাবে একটা সিগারেট টানছেন। সোমনাথ মাথা উঁচু করে বসে আছে। যত লজ্জা শুধু শিউলি দাসেরই। তার প্রাপ্য টাকা অনেক আগেই চুকিয়ে দিয়েছে সোমনাথ। নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে মাথা নিচু করে আর একটিও কথা না বলে সন্ত্রস্ত হরিণীর মতো শিউলি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
গোয়েঙ্কা এবার একটু কপট ব্যস্ততা দেখালেন। শিউলির যা প্রাপ্য তা অনেক আগেই চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এই বলে সোমনাথ তাঁকে আশ্বস্ত করলো।
সন্তুষ্ট গোয়েঙ্কা বললেন, “শিউলি ইজ ভেরি গুড। কিন্তু, লাইক অল বেঙ্গলী, নিজের ব্যবসায়ে থাকতে চায় না। বিছানাতে শুয়েও বলছে, একটা ছেলের চাকরি করে দিন।”
আজ কল্পতরু হয়েছেন মিস্টার গোয়েঙ্কা। সোমনাথের সঙ্গে করমর্দন করলেন। বললেন, “আপনার অর্ডারের চিঠি আমি টাইপ করে এনেছি। আপনি রেগুলার প্রতি মাসে কেমিক্যাল সাপ্লাই করে যান। দু-নম্বর মিলের কাজটাও আপনাকে দেবার চেষ্টা করবো। আর দেরি নয়। আমার শ্বশুরবাড়িতে এখন আবার ডিনারের নেমন্তন্ন রয়েছে,” এই বলে মিস্টার গোয়েঙ্কা নিজের জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করলেন।
প্রচণ্ড এক উল্লাস অনুভব করছে সোমনাথ। গোয়েঙ্কার লেখা চিঠিখানা সে আবার স্পর্শ করলো। সোমনাথ ব্যানার্জি তাহলে অবশেষে জিতেছে। সোমনাথ এখন প্রতিষ্ঠিত।
গোয়েঙ্কার ঘর থেকে বেরিয়ে সোমনাথ থমকে দাঁড়ালো। আবার চিঠিখানা স্পর্শ করলো।
করিডরেই নটবরবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। হুঙ্কার দিয়ে নটবর বললেন, “আজকেই চিঠি পেয়ে গেলেন? গোয়েঙ্কা তাহলে আপনাকে বিজনেসে দাঁড় করিয়ে দিলো! কংগ্রাচুলেশন, আমি ঠিক আন্দাজ করেছিলাম, ব্যাটা চিঠি তৈরি করে নিয়ে আসবে।”
সোমনাথের ধন্যবাদের জন্যে অপেক্ষা করলেন না নটবরবাবু। বললেন, “পরে কথা হবে। মিসেস বিশ্বাসের দেমাক আমি ভাঙতে চাই। মেয়েটাকে একটু দেখে আসি—ঘরে আছে তো?”
এইমাত্র যে শিউলি দাস বেরিয়ে গেলো তা জানালো সোমনাথ।
“এইমাত্র যে মেয়েটার সঙ্গে করিডরে আমার দেখা হলো? লাল রংয়ের তাঁতের শাড়ি পরা? চোখে চশমা? হাতে কালো ব্যাগ?”
সোমনাথ বললো, “হ্যাঁ। ওই তো শিউলি দাস।”
“শিউলি দাস কোথায়?” একটু অবাক হলেন নটবর মিত্র। “ওঁকে তো আমি চিনি। আমাদের যাদবপুরের পাড়ায় থাকে। তাহলে নাম ভাঁড়িয়ে এ-লাইনে এসেছে। এ-লাইনে কোনো মেয়েই অবশ্য ঠিক নাম বলে না। ওর নাম তো কণা।” নটবরবাবু বললেন, “দাস হলো কবে থেকে? ওরা তো মিত্তির। ওর বাবাকে চিনি—সবে রিটায়ার করেছে। আর ভাইটা মশাই ইদানীং ডাহা পাগল হয়ে গেছে—সুকুমার না কী নাম।”
অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের আনন্দে নটবর মিত্তির এখন বিমোহিত। বললেন, “কী আশ্চর্য দেখুন—সারা শহর খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত যাকে নিয়ে আসা হলো সে পাশের বাড়ির লোক। খুব অভাব ছিল ওদের, তা ভালোই করেছে।”
হঠাৎ ভীষণ ভয় লাগছে সোমনাথের। কাল যখন তপতী তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে তখন সোমনাথের মুখটা যদি গরিলার মতো দেখায়? তপতী তখনও কি ভালোবাসতে পারবে? তপতী যেন বলেছিল সোমনাথের নিষ্পাপ মুখের সরল হাসি দেখেই সে হৃদয় দিয়েছিল।
“কণা, কণা, কণা” পাগলের মতো কণাকে ডাকতে ডাকতে সোমনাথ গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলের গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত ছুটে এসেছিল। কিন্তু কোথায় সুকুমারের বোন? সে চলে গিয়েছে।
৩২. মাতালের মতো টলছে সোমনাথ ব্যানার্জি
যোধপুর পার্কে নিজেদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মাতালের মতো টলছে সোমনাথ ব্যানার্জি। হাতে তার দুখানা উপহারের শাড়ি এবং পকেটে সেই চিঠিটা–যা তাকে সমস্ত অর্থনৈতিক অপমান থেকে মুক্তি দিয়েছে। সোমনাথ এখন আর চাকরির ভিখিরি নয়—সে এখন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। প্রতি মাসে একটা অর্ডার থেকেই হাজার টাকা রোজগার করবে সে। কারুর কাছে আর ভিখিরি থাকতে হবে না সোমনাথকে। তপতীকে জানিয়ে দেবে সে আর কাউকে ভয় করে না।
কমলা বউদিকেই প্রথম খবরটা দিলো সোমনাথ। তারপর শাড়িটা এগিয়ে দিলো। কমলা বউদি বুঝলেন, সোমনাথ আজ বড় একটা কিছু করেছে। “তুমি আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছ তাহলে?” কমলা বউদি গভীর আনন্দের সঙ্গে বললেন।
আনন্দে আত্মহারা হয়ে বউদি এবার দেওরের দেওয়া প্রথম উপহারের প্যাকেট খুলে ফেললেন। বললেন, “বাঃ।” সোমনাথকে খুশী করার জন্যে বউদি এখনই সেই শাড়ি পরতে গেলেন। বললেন, “এই শাড়ি পরেই জন্মদিনের পায়েস পরিবেশন করবো।”
বউদি পাশের ঘরে যেতে-না-যেতেই সোমনাথ কাতরভাবে ডাকলো, “বউদি!”
“কী হলো তোমার? অমনভাবে চিৎকার করছো কেন?” বউদি ফিরে এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
করুণভাবে সোমনাথ বললো, “বউদি, ওই কাপড়টা আপনি পরবেন না।”
“কেন? কি হলো?” কমলা কিছুই বুঝতে পারছেন না।
“ওতে অনেক নোংরা বউদি?” আমতা-আমতা করতে লাগলো সোমনাথ। সকালে যখন কিনেছিলাম তখনও বেশ পরিষ্কার ছিল। এই সন্ধ্যেবেলায় হঠাৎ নোংরা হয়ে গেলো। ওতে অনেকরকম ময়লা আছে বউদি-আপনি পরবেন না!”