ফিক করে হাসলো চরণদাস। “আপনি ভাবছেন, তিনটে থেকে ডিউটি অথচ এখনও আসেনি কেন?”
চরণদাস নিজেই উত্তর দিলো, “একেবারে নতুন দিন কয়েক হলো লাইনে জয়েন করেছে। গেরস্ত চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘরে ঘরে, কিছু না পেয়ে এ-লাইনে এসেছে। বিকেলের দিকে তো আমাদের খদ্দেরের কাজের চাপ থাকে না। আমাকে বলে গেছে একবার হাসপাতালে যাবে কীসের খোঁজ করতে।”
চরণদাস বললো, “খুব ভালো মেয়েমানুষ পাবেন স্যর। যিনি ভেট নেবেন, দেখবেন, তিনি কীরকম খুশী হন। অনেকদিন তো এ-লাইনে হয়ে গেলো। ছোটবেলা থেকে দেখছি, এ-লাইনে নতুন জিনিসের খুব কদর। আমাদের বোর্ডিং-এ গেরস্ত ঘর থেকে আনকোরা মেয়ে এলেই খদ্দেরের মধ্যে হৈ-হৈ পড়ে যেতো। এক-একবার দেখেছি, লাইন পড়ে যেতো। এক খদ্দের ড়ুকেছে—আরও দুজন খদ্দের সোফায় বসে সিগ্রেট টানছে। নতুন রিফিউজি মেয়েগুলো পাঁচমিনিট বিশ্রাম নেবার সময় পেতো না।” একটা বিড়ি ধরালো চরণদাস। বললো, “আপনাকে যে মেয়ে দেবো একেবারে ফ্রেশ জিনিস। ভয় পর্যন্ত ভাঙেনি। সাড়ে নটার পর এক মিনিটও বসবে না। আমাকে আবার বালিগঞ্জের মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে হয়। আমার বাড়ি অবশ্য একই রাস্তায় পড়ে—দুটো-একটা টাকাও পাওয়া যায়।”
মেয়েটি আসতেই চরণদাস সব ব্যবস্থা করে দিলো। বললো, “পাঁচটা মিনিট সময় দিন, স্যর। একটু ড্রেস করে নিক। আমাদের এখানে সব ব্যবস্থা আছে।”
পাঁচমিনিটের মধ্যেই মেয়েটি তৈরি হয়ে নিলো। চরণদাস এবার সোমনাথকে জিজ্ঞেস করলো, “শাড়ির রংটা পছন্দ হয়েছে তো না হলে বলুন। আমাদের এখানে স্পেশাল শাড়ি আছে—খদ্দেরের পছন্দ অনুযায়ী অনেক সময় মেয়েরা জামা-কাপড় পাল্টে নেয়!”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সোমনাথ দেখলো আর একটুও সময় নেই। মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে চরণদাস এবার সোমনাথকে লম্বা সেলাম দিলো। সোমনাথ পকেট থেকে দশটা টাকা বার করে চরণদাসের হাতে দিলো। বেজায় খুশী চরণদাস। বললো, “আপনারা যাচ্ছেন কোথায়?”
“গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলে,” সোমনাথ উত্তর দিলো। নিজের শান্ত কণ্ঠস্বরে সোমনাথ নিজেই অবাক হয়ে গেলো। এই অবস্থাতেও তার গলা কেঁপে উঠলো না। মেয়েটাকে গাড়ির মধ্যে তুলে নিতে একটুও লজ্জা হলো না। কেন লজ্জা হবে?” রক্তচক্ষু এক সোমনাথ আর-এক শান্ত সুসভ্য সোমনাথকে জিজ্ঞেস করলো। তিন বছর যখন তিলে তিলে যন্ত্রণা সহ্য করেছি, তখন তো কেউ একবারও খবর করেনি, আমার কী হবে? আমি কেমন আছি?”
মেয়েটি একেবারে নতুন। এখনও গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেল চেনে না! জিজ্ঞেস করলো, “অনেক দুরে নাকি?”
মেয়েটিকে বেশ ভীতু মনে হচ্ছে সোমনাথের। এদেশের লাখ লাখ বোকা ছেলেমেয়ের মতোই সদাশঙ্কিত হয়ে আছে। নিজের নাম বললো, “শিউলি দাস। আপনার কাছে একটা অনুরোধ আছে,” শিউলির গলায় কাতর অনুনয়।
“দয়া করে বেশি দেরি করবেন না। দশটার মধ্যে বাড়ি না ফিরলে আমার মা অজ্ঞান হয়ে যাবেন।”
জনবিরল মেয়ো রোড ধরে গাড়িতে যেতে যেতে শিউলি জিজ্ঞেস করলো, “আপনার নাম?” শিউলি যখন নিজের নাম জানিয়েছে, তখন সোমনাথের নাম জানবার অধিকার তার নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সোমনাথ কেমন ইতস্তত বোধ করছে—জীবনে এই প্রথম নিজের পরিচয়টা লজ্জার উদ্রেক করছে। প্রশ্নটার পুরো উত্তর দিলো না সে। গম্ভীরভাবে বললো, “ব্যানার্জি।” মেয়েটা সত্যিই আনকোরা, কারণ ব্যানার্জির আগে কী আছে জানতে চাইলো না। চাইলেও অবশ্য সোমনাথ প্রস্তুত হয়েছিল একটা মিথ্যে উত্তর দিতো।
চিন্তজালে জড়িয়ে পড়েছে সোমনাথ। যে-নগরীকে একদা গহন অরণ্য মনে হয়েছিল সেই অরণ্যের নিরীহ সদাসন্ত্রস্ত মেষশাবক সোমনাথ সহসা শক্তিমান সিংহশিশুতে রুপান্তরিত হয়েছে। নিরীহ এক হরিণীকে কেমন অবলীলাক্রমে সে চরম সর্বনাশের জন্য নিয়ে চলেছে।
গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলের অভিজ্ঞ দারোয়ানজীও শিউলিকে দেখে কিছু সন্দেহ করলেন। দারোয়ানজীর দোষ কী? এই প্রথম দেখছেন শিউলিকে।
৩০. গোয়েঙ্কাজীর ঘরে
গোয়েঙ্কাজীর ঘরে টোকা পড়তেই তিনি নিজে দরজা খুলে দিলেন। সোমনাথের জন্যে তিনি অপেক্ষা করছেন।
আজ একটু স্পেশাল সাজগোজ করেছেন গোয়েঙ্কাজী! সাদা গরদের দামী পাঞ্জাবী পরেছেন তিনি। ধুতিটা জামাইবাবদের মতো চুনোট করা। গায়ে বিলিতী সেন্টের গন্ধ ভুরভুর করছে। পানের পিচে ঠোঁট দুটো লাল হয়ে আছে। মুখের তেল-চকচক ভাবটা নেইএখানে এসে বোধহয় আর এক দফা স্নান সেরে নিয়েছেন।
আড়চোখে শিউলিকে দেখলেন গোয়েঙ্কা। সাদরে বসতে দিলেন দুজনকে।
নটবরবাবু বারবার বলে দিয়েছিলেন, “গোয়েঙ্কাকে বোলো, ওর স্পেসিফিকেশন জানা থাকায়, আমাদের বিদ্যেবধি মতো মেয়েমানুষ চয়েস করেছি। একটু কেয়ারফুলি গোয়েঙ্কাকে স্টাডি কোরো। যদি বোঝো জিনিস তেমন পছন্দ হয়নি, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বোলো, এর পরের বারে আপনি যেমনটি চাইবেন ঠিক তেমনটি এনে রাখবো।”
এসব প্রশ্ন উঠলো না। কারণ গোয়েঙ্কাজীর হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে সঙ্গিনীকে তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে।
সোমনাথের সমস্ত শরীর অকস্মাৎ মিশরের মমির মতো শক্ত হয়ে আসছে। তার চোয়াল খুলতে চাইছে না। নটবরবাবু বারবার বলেছিলেন, “জিজ্ঞেস করবে, কলকাতায় আসবার পথে গোয়েঙ্কাজীর কোনো কষ্ট হয়েছিল কিনা?”
গোয়েঙ্কাজী বললেন, “আমি এসেই আপনার চিঠি পেলাম। কষ্ট করে আবার ফুল পাঠাতে গেলেন কেন?”
“তোমাকে জুতো মারা উচিত ছিল, এই বলতে পারলেই ভিতরের সোমনাথ শান্তি পেতো। কিন্তু সোমনাথের মমিটা কিছুই বললো না।।