সেই চিঠিটার জন্যেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সোমনাথ। কখন কমলা বউদি ঘরে টোকা দেবেন, হাসি মুখে বলবেন, “নাও তোমার চিঠি এইমাত্র পিওন দিয়ে গেলো।”
সত্যিই দরজায় টোকা পড়ছে। সোমনাথের ঘুম ভেঙে গেলো। চুড়ির আওয়াজেই সোমনাথ বুঝতে পারছে কে ধাক্কা দিচ্ছে। তাহলে এই ইন্টারভিউ-এর ব্যাপারটাই মিথ্যা—ভোরবেলায় সোমনাথ এতোক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখছিল।
সোমনাথ দরজা খুলে দিলো। মেজদার বউ বুলবুল দাঁড়িয়ে রয়েছে। বুলবুলের সঙ্গে সোমনাথের একটু রসিকতার সম্পর্ক। ওঁরা একসঙ্গে চার বছর কলেজে পড়েছে। বুলবুল বললে, গুড মর্ণিং। পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল। আর কতক্ষণ ঘুমবে?”
মুখ গম্ভীর করে সোমনাথ শুয়ে রইলো। মনে মনে বললে, “বেকার মানুষ সকালসকাল উঠেই বা কী করবো?”
বুলবুল বললে, “দিদির হুকুম, সোমকে তুলে দাও।”
“বউদি কোথায়?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।
“বউদি এখন নিজের কাজে ব্যস্ত।”
সোমনাথ একমত হলো না। “বউদির একমাত্র ছেলে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল রয়েছে। বউদির কর্তাটি বেশ কিছুদিন অফিসের কাজে কলকাতার বাইরে। সুতরাং বউদি এখন নিজের কাজে কি করে ব্যস্ত থাকবেন?”
বুলবুল ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো, “দাঁড়াও, দিদিকে রিপোর্ট করছি। কর্তা ছাড়া আমাদের বুঝি কোনো কাজকর্ম নেই।”
সোমনাথ অধৈর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আঃ! বলো না বউদি কোথায়?”
বুলবুল হেসে বললো, “আমিও তো তোমার বউদি।”
সোমনাথ বললো, “তোমাকে তো আমি এখনও বউদি বলে রেকগনাইজ করি নি। দাদার বউ হলেই বউদি হওয়া যায় না বুঝলে?”
“তবে কী হওয়া যায়?” সহাস্যে বুলবুল চোখ দুটো বড় বড় করে জানতে চাইলো।
“সে সব তোমাকে বোঝাতে অনেক সময় লাগবে,” সোমনাথ উত্তর দিলো। “সময় মতো বলা যাবে। এখন বলো বউদি কোথায়?”
বুলবুল বললো, “দিদি দোতলার ব্যালকনিতে বসে বাবার সঙ্গে কথা বলছেন। মাথায় অনেক দায়িত্ব, হাজার হোক বাড়ির বড় গিন্নি তো।”
সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কর্তা ঘুম থেকে উঠেছে?”
“কোন, সকালে উঠে পড়েছে। অফিসে কী সব জরুরী মিটিং আছে, এখনই গাড়ি আসবে। তাই বাথরুমে ঢুকেছে।”
বুলবুল আরও জানালো, “ওর অফিসে কী যে হয়েছে! শুধু কাজ আর কাজ। লোকটাকে খাটিয়ে খাটিয়ে মারছে।” সোমনাথের জন্যে বুলবুল এবার চা আনতে গেলো।
অফিসে এই খাটিয়ে মেরে ফেলার প্রসঙ্গটা সোমনাথের ভালো লাগলো না। চাকরি পেলে অফিসে খুব খাটতে হাজার হাজার বেকারের মোটেই আপত্তি নেই। চাকরিওয়ালা লোকগুলো বেশ আছে। চাকরি করছো এই না যথেষ্ট—তবু মন ওঠে না, কাজেও আপত্তি।
০৩. চা খেয়ে সোমনাথ চুপচাপ বসেছিল
চা খেয়ে সোমনাথ চুপচাপ বসেছিল। কী করবে ভেবে ঠিক করতে পারছিল না। হাত-পা গটিয়ে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া বেকারদের কীই-বা করবার আছে।
কমলা বউদি ওপর থেকে ইংরিজি খবরের কাগজখানা নামিয়ে আনলেন। সোমনাথ দেখলো, বাবা ইতিমধ্যেই কয়েকটা চাকরির বিজ্ঞাপনে লাল পেন্সিলের মাকা দিয়েছেন। বাবার এইটাই প্রাত্যহিক কাজ। খবরের কাগজে প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে বাবা সর্বপ্রথম দ্বিতীয় পাতায় ‘চাকরি খালি’ শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনগুলো পড়ে ফেলেন। প্রয়োজন মতো লাল দাগ মারেন। বিজ্ঞাপনগুলো তখন কাটেন না, কারণ বাড়ির অন্য লোকেরা কাগজ পড়বে। দুপুরে খাবার পর কমলা বউদি আবার খবরের কাগজগুলো বাবার কাছে পৌঁছে দেন। বাবা নিজের হাতে ব্লেড দিয়ে বিজ্ঞাপনগুলো কেটে সোমনাথের কাছে পাঠিয়ে দেন।
কমলা বউদির ইচ্ছে নয় সোমনাথ চুপচাপ বাড়িতে বসে সময় কাটায়। তাই প্রায় জোর করেই একবার ওকে গড়িয়াহাট বাজারে পাঠালেন। বললেন, “তোমার দাদা নেই-শ্রীমান ভজহরির ওপর প্রত্যেকদিন নির্ভর করতে সাহস হয় না। বেশি দাম দিয়ে খারাপ জিনিস নিয়ে আসে। ওর দোষ নয়, গরীব মানুষ দেখলে আজকাল দোকানদাররাও ঠকায়।”
পাজামার ওপর একটা পাঞ্জাবী গলিয়ে সোমনাথ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। হাতে থলে নিয়ে যে সোমনাথ গড়িয়াহাট বাজার থেকে পুকুরের বাটা মাছ কিনছে তা দেখে কে বলবে বাংলার লক্ষ লক্ষ হতভাগ্য বেকারদের সে একজন? জিনিসপত্তর কিনতে কিনতে অনেকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অফিস যাবার মতো যথেষ্ট সময় আছে কিনা দেখে নিচ্ছেন। সোমনাথের কীরকম অস্বস্তি লাগছে—ওর যে অফিসে যাবার তাড়া নেই তা লোকে বুঝুক সে মোটেই চায় না।
কলেজে পড়বার সময়ে সোমনাথ কতবার বাজার করেছে। কিন্তু কখনও এই ধরনের অস্বস্তি অনুভব করেনি। পরিচিত কারুর সঙ্গে বাজারে বা রাস্তায় দেখা হলে তার ভালোই লেগেছে। কিন্তু এখন দূর থেকে কাউকে দেখুলেই সে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। কারণ আর কিছু নয়, লোকে বেমালুম জিজ্ঞেস করে বসে, “কী করছো?” যতদিন কলেজের খাতায় নাম ছিল, ততদিন উত্তর দেবার অসুবিধা ছিল না। যত মুশকিল এখনই।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে হয়। বাজারের গেটের কাছেই সোমনাথ শুনতে পেলো, “সোমনাথ না? কী ব্যাপার তোমার, অনেকদিন কোনো খবরাখবর নেই!”
সোমনাথ মুখ তুলে দেখলো অরবিন্দ সেন। ওদের সঙ্গেই কলেজে পড়তো। অরবিন্দ নিজেই বললো, “ইউ উইল বি গ্লাড, টু নো বেস্ট-কীন-রিচার্ডসে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হয়েছি। এখন সাতশ’ দিচ্ছে। গড়িয়াহাট মোড় থেকে মিনিবাসে কোম্পানির ফ্যাকটরিতে নিয়ে যায়। এখানে সাড়ে-সাতটার সময় আমাকে রোজ দেখতে পাবে। রাস্তার ওপারে দাঁড়াই-সিগারেট কেনবার জন্যে ভাগ্যিস এইপারে এসেছিলাম তাই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।”