“এখন কী করছো চরণ?” নটবর মিত্তির জিজ্ঞেস করলেন।
আগেকার দিন নেই হুজুর। এখন টুকটাক অর্ডার সাপ্লাই করছি। আমাদের ম্যানেজারবাবু করমচন্দানী জেল থেকে বেরিয়ে একটা স্কুল করেছেন। টেলিফোন অপ্রেটিং শেখবার নাম করে কিছু মেয়ে আসে—খুব জানাশোনা পার্টির খবর পেয়েছেন, কোনোরকমে চলে যায়।”
নটবর জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা চরণ, চাহিদার তুলনায় মেয়ের সাপ্লাই কি কমে গিয়েছে?”
“মোটেই না, হুজুর। গেরস্ত ঘর থেকে আজকাল অজস্র মেয়ে আসছে। কিন্তু তাদের আমরা জায়গা দিতে পারি না। এসব পাড়ায় জায়গার বড় অভাব।”
নটবর মিত্তির হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, “চরণ, তুমি তো আমার বহুদিনের বন্ধু। এখনই একটি ভালো মেয়ে দিতে পারো?”
চরণ বললো, “কেন পারবো না হুজুর? এখনই চলুন, তিনটে মেয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি।”
“একেবারে টপ ক্লাস হওয়া চাই। রাস্তার জিনিস তুলে নেবার জন্যে তোমার সাহায্য চাইছি না,” নটবর বললেন।
চরণদাস এবার ব্যাপারটার গুরত্ব বুঝলো। বললো, “তাহলে হুজুর, একটু অপেক্ষা করতে হবে। মিনিট পনেরো পরেই একটি ভালো বাঙালী মেয়ে আসবে। তবে মেয়েটি খুব দূরে যেতে ভয় পায়। গেরস্ত ঘরের মেয়ে তো, লুকিয়ে আসে।”
“রাখো রাখো—সবাই গেরস্ত,” ব্যঙ্গ করলেন নটবর।
চরণদাস উত্তর দিলো, “এই ভর সন্ধ্যেবেলায় আপনাকে মিথ্যে বলবো না, হুজুর।”
“চরণদাস, ভেট হিসেবে দেবার মতো জিনিস তো?” নটবর মিত্তির খোলাখুলি জিজ্ঞেস করলেন।
“একদম নির্ভয়ে নিয়ে যেতে পারেন। রাঙতায় মুড়ে বড়দিনের ডালিতে সাজিয়ে দেবার মতো মেয়ে, স্যর!” চরণদাস বেশ জোরের সঙ্গে বললো।
চরণদাসের ঘাড়ে সোমনাথকে চাপিয়ে নটবর এবার পালালেন। বললেন, “ঊষা জৈনকে এখন না তুললেই নয়। মাগীর যা দেমাক, হয়তো দেরি করলে অর্ডার ক্যানসেল করে দেবে—সঙ্গে আসবেই না। আপনি ভাববেন না সোমনাথবাবু, বার বার তিনবার। এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সোমনাথকে নিশ্চল পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে থাকতে দেখে নটবর বললেন, “ভয় কী? একটু পরেই তো গ্রেট ইন্ডিয়ানে দেখা হচ্ছে। তেমন দরকার হলে আমি নিজে গোয়েঙ্কার সঙ্গে আপনার হয়ে কথা বলবো।”
“বাই-বাই,” করে নটবর মিত্তির বেরিয়ে গেলেন। আর দাঁতে দাঁত চেপে সোমনাথ এবার চরণদাসের সঙ্গে রাসেল স্ট্রীট ধরে উত্তর দিকে হাঁটতে লাগলো। দুটো অ্যাসপ্রো ট্যাবলেটেও শরীরের যন্ত্রণা কমেনি—কিন্তু অনেক চেষ্টায় মনকে পুরোপুরি নিজের তাঁবেতে এনেছে সোমনাথ।
কী আশ্চর্য! দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির ভদ্র সভ্য সুশিক্ষিত ছোটছেলে এই অন্ধকারে মেয়েমানুষের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে—অথচ তার কনসেন্স তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে না। সোমনাথ এখন বেপরোয়া। জলে যখন নেমেছেই, তখন এর চুড়ান্ত না দেখে আজ সে ফিরবে না। জন-অরণ্যে সে অনেকবার হেরেছে—কিন্তু শেষ রাউন্ডে সে জিতবেই।
অন্ধকারের অবগুণ্ঠন নেমে এসেছে নগর কলকাতার ওপর। রাত্রি গভীর নয়—কিন্তু সোমনাথের মনে হচ্ছে গহন অরণ্যের ধার দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ সূর্য অস্ত গিয়ে সর্বত্র এক বিপজ্জনক অন্ধকার নেমে এসেছে। চরণদাস বললো, “নটবরবাবু এ-লাইনের নামকরা লোক। ওঁকে ঠকিয়ে অর্ডার সাপ্লাই বিজনেসে আমি টিকতে পারবো না। আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনাকে খারাপ জিনিস দেবো না কিছুতেই।”
এই বৃদ্ধকে কে বোঝাবে, মানুষ কখনও খারাপ হয় না, সোমনাথ নিজের মনে বললো। চরণদাস তার সহযাত্রীর মনের খবর রাখলো না। বললো, “গভরমেন্টের কী অন্যায় দেখুন তো? চাকরি দিতে পারবি না অথচ বোডিং—এ আট-দশটি মেয়ে এবং আমরা তিন-চারজন করে খাচ্ছিলাম তা সহ্য হলো না।”
চরণদাস বলে চললো, “বন্ধ করতে তো পারলে না, বাবা। শুধু কচিকচি মেয়েগুলোকে কষ্ট দেওয়া। জানেন, কতদূর থেকে সব আসে—গড়িয়া, নাকতলা, টালিগঞ্জ, বৈষ্ণবঘাটা। আর একদল আসে বারাসত, দত্তপুকুর, হাবড়া এবং গোবরডাঙ্গা থেকে। বোর্ডিং—এ অনেক বসার জায়গা ছিল। মেয়েগুলোর কষ্ট হতো না। এখন এই টেলিফোন স্কুলে কয়েকখানা ভাঙা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। কখন পার্টি এসে তুলে নিয়ে যাবে এই আশায় মেয়েগুলোকে তীর্থ কাকের মতো বসে থাকতে হয়।”
চরণদাসের বকা স্বভাব। নীরব শ্রোতা পেয়ে সে বলে যাচ্ছে, “যেসব মেয়ের চক্ষু লজ্জা নেই, তারা নাচের স্কুলে চলে যাচ্ছে। বলরুম নাচ শেখানো হয় বলে ওরা বিজ্ঞাপন দেয়—অনেক উটকো লোক আসে, কিছু, চাপা থাকে না। আমাদের টেলিফোন স্কুলে সুবিধে এখনও তেমন কেউ জানে না, ভদ্রঘরের মেয়েদের পক্ষে বাড়িতে বলতেও ভালো। সাতদিন ‘অপ্রেটর ট্রেনিং’-এর পরই ডেলি রোজ-এর কাজুয়েল চাকরি। বাপ-মা খুব চেপে ধরলে আমাদের মেয়েরা বলে, বদলী অপ্রেটরদের বিকেল তিনটে-দশটার চাকরিটাই সহজে পাওয়া যায়। কারণ এ-সময়ে অফিসের মাস-মাইনের মেয়েরা কাজ করতে চায় না। বাপেরা অনেক সময় আমাদের এখানে ফোন করে। আমরা বলি, লিভ ভেকাসিতে কাজ করতে করতেই আপনার মেয়ে হঠাৎ ‘পার্মেন্ট’ চাকরি পেয়ে যাবে।”
চরণদাস এবার একটা পুরানো বাড়িতে কে পড়লো। দুটো মেয়ে টেলিফোন স্কুলে এখনও বসে আছে। একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান—বোধহয় দেহে কিছু নিগ্রো রক্ত আছে। উগ্র এবং অসভ্য বেশবাস করেছে মেয়েটি। আরেক জন সিন্ধি—হাল ফ্যাশানের লুঙ্গী পরেছে। সোমনাথকে দেখে দুজন মেয়েই চাপা উত্তেজনায় দুবার মুখ বাড়িয়ে দেখে গেলো। চরণদাস বললো, “আপনি মিত্তির সায়েবের লোক—এসব জিনিস আপনাকে দেওয়া চলবে না। এরা ভারি অসভ্য—একেবারে বাজারের বেশ্যা। একটু বসুন—আপনার জিনিস এখনই এসে পড়বে।”