মিসেস বিশ্বাসের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লীলা চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো। পিছনে আঠারো-উনিশ বছরের এক ছোকরা। নিশ্চয় ছাত্র, কারণ হাতে কলেজের বই রয়েছে। মিশনারি কলেজের নামলেখা একটা খাতাও দেখা যাচ্ছে। লীলা বললো, “মিস্টার পোদ্দার আর একটা ডেট চাইছেন।” ব্যাগ থেকে ডাইরি বার করে, চোখে চশমা লাগিয়ে মিসেস বিশ্বাস বললেন, “ইট ইজ এ প্লেজার। কবে আসবেন বলুন?” তারিখ ও সময় ঠিক করে মিসেস বিশ্বাস ডাইরিতে লিখে রাখলেন। বললেন, “ঠিক সময়ে আসবেন কিন্তু ভাই—দেরি করলে আমাদের প্রোগ্রাম আপসেট হয়ে যায়।”
পোদ্দার চলে যেতেই মিসেস বিশ্বাস আবার ডাইরি দেখলেন। তারপর বললেন, “লীলা, তুমি একটু কফি খেয়ে বিশ্রাম নাও। আবদুলকে বলো, তোমার ঘরে বিছানার চাদর এবং তোয়ালে পাল্টে দিতে। মিনিট পঁচিশের মধ্যে মিস্টার নাগরাজন আসবেন। উনি আবার দেরি করতে পারবেন না। এখান থেকে সোজা এয়ারপোর্ট চলে যাবেন।”
লীলা ভিতরে চলে যেতেই মিসেস বিশ্বাস বললেন, “টাকা নিই বটে—কিন্তু সার্ভিসও দিই। প্রত্যেক কাস্টমারের জন্যে আমার এখানে ফ্রেস বেডশিট এবং তোয়ালের ব্যবস্থা। অ্যাটাচড বাথরুমে নতুন সাবান। প্রত্যেক ঘরে ট্যালকম পাউডার, লোশন, অডিকোলন, ডেটল। যত খুশী কফি খাও—একটি পয়সা দিতে হবে না।”
নটবর মিত্রকে ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখে মিসেস বিশ্বাস বললেন, “ঝুমুটার এখনও হলো না? দাঁড়ান, ফুটো দিয়ে দেখে আসি। মেয়েটার ঐ দোষ। খদ্দেরকে ঝটপট খুশী করে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারে না। ভাবছে, সবাই জাপানী সায়েব। বেশি সময় আদর পেলে, খুশী হয়ে ওকে মুক্তোর মালা দিয়ে যাবে! এসব ব্যাপারে লীলা চালাক। নতুন লাইনে এলেও কায়দাটা শিখে নিয়েছে। পোন্দার একঘণ্টা থাকবে বলে এসেছিল, কিন্তু কুড়ি মিনিটের মধ্যে সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলো। অথচ লীলার অনেক আগে ঝুমু খদ্দের নিয়ে দরজা বন্ধ করেছে।”
ফুটো দিয়ে মেয়ের লেটেস্ট অবস্থা দেখে হেলেদুলে ফিরে এলেন মিসেস বিশ্বাস। বললেন, “আর দেরি হবে না। টোকা দিয়ে এসেছি। তারপর বললেন, “আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে ঝুমুর চেহারাটা বেশ হয়েছে। যে দ্যাখে সেই সন্তুষ্ট হয়। টোকিও থেকে আপনার জাপানী সায়েব তো আবার বন্ধু পাঠিয়েছিলেন। হোটেলে মালপত্র রেখে সায়েব নিজে খোঁজখবর করে এখানে এসেছিলেন। ভলো ছবি তোলেন। খুব ইচ্ছে ছিল জামাকাপড় খুলিয়ে ঝুমুর একটা রঙীন ছবি তোলেন। পাঁচশ’ টাকা ফী দিতে চাইলেন! আমি রাজী হলাম না।”
নটবর এবার সুযোগ নিলেন। বললেন, “আমার এই ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতাম ঝুমুর। ওকে ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে একটু গ্রেট ইন্ডিয়ানে নিয়ে যেতে চাই।”
মুখ বেকালেন মিসেস বিশ্বাস। তারপর সোমনাথকে বললেন, “হোটেলে কেন বাছা? আমার এখানেই বসো না। মিস্টার জয়গোয়াল চলে গেলেই ঝুমু ফ্রি হয়ে যাবে। আমার চেম্বারভাড়া হোটেলের অর্ধেক।”
হাঁ-হাঁ করে উঠলেন নটবরবাবু “উনি নন, ওঁর এক পাটি।”
মিসেস বিশ্বাস বললেন, “তাঁকেও নিয়ে আসন এখানে। আমার লোকজন কম। মেয়েদের বাইরে পাঠালে বড্ড সময় নষ্ট হয়। তাছাড়া এখন কাজের চাপ খুব, মিস্টার মিত্তির! হোল নাইট বুকিং-এর জন্যে হাতে-পায়ে ধরছে।”
অনেক অনুরোধ করলেন নটবরবাবু। কিন্তু মিসেস বিবাস রাজী হলেন না। বললেন, “ঝুমু তো রইলো। আপনার সায়েবকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এখানে নিয়ে আসুন। ঝুমুকে স্পেশাল আদর-যত্ন করতে বলে দেবো। দেখবেন আপনার সায়েব কীরকম সন্তুষ্ট হন। ওদের দুজনকে কাজে বসিয়ে দিয়ে আমরা তিনজন চা খেতে খেতে গল্প করবো।”
রাস্তায় বেরিয়ে সোমনাথ দেখলো নটবর মিটার দুটো হাতেই ঘষি পাকাচ্ছেন। সোমনাথের কাছে ছোট হয়ে গিয়েছেন মনে করছেন। অথচ সোমনাথ সেরকম ভাবছেই না। সামনের পানের দোকান থেকে সোমনাথ দুটো অ্যাসপ্রো কিনে খেয়ে ফেললো। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সে মনকে তৈরি করে ফেলেছে। কিন্তু দেহটা কথা শুনছে না। একটু বমি করলে শরীরটা বোধহয় শান্ত হতো।
নটবরবাবু বললেন, “আপনার কপালটাই পোড়া। নটবর মিত্তির যা চাইছে, তা দিতে পারছে না আপনাকে। আর দেশটারই বা হলো কি! মেয়েমানুষের ডিমান্ড হুড়হুড় করে বেড়ে যাচ্ছে। ছ’মাস আগে এই মিসেস বিশ্বাস দুপুরবেলায় মেয়ে নিয়ে আমার অফিসে দেখা করেছেন—পার্টির জন্যে হাতে ধরেছেন। কতবার বলেছেন, শুধু তো খদ্দের আনছেন। একদিন নিজে রুমু কিংবা ঝুমুর সঙ্গে বসুন–কোনো খরচ খরচা লাগবে না। কিন্তু মশাই, নটবর মিত্তির এসব থেকে একশ’ গজ দূরে থাকে। নিজে যেন এসবের মধ্যে ঢুকে পড়বেন না—তাহলে কিন্তু সর্বনাশ হবে ওই বিশ, বোসের মতন।”
কোনো কথা শুনলেন না নটবর। সোমনাথকে নিয়ে পাক স্ট্রীটের কোয়ালিটিতে বসে কফি খেলেন। ওখান থেকে বেরিয়েই অলিম্পিয়া বার-এর সামনে বুড়ো চরণদাসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।
“চরণ না?” নটবর জিজ্ঞেস করলেন।
“আজ্ঞে, হ্যাঁ হুজুর,” বহুদিন পরে নটবরকে দেখে খুশী হয়েছেন চরণদাস।
“তোমার বোডিং—এ না পুলিশ হামলা হয়েছিল?” নটবর অনেক কিছু খবর রাখেন।
“শুধু পুলিশ হামলা! আমাকে আসামীর কাঠগড়ায় তুলেছিল।” চরণ দুঃখ করলো। “কোনোরকমে ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসেছি।”
চরণের বয়স হবে পঞ্চাশের বেশি। শুকনো দড়ি-পাকানো চেহারা। কিন্তু দেখুলেই বোঝা যায় নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। সোমনাথকে নটবর বললেন, “চরণ এখানকার এক বোডিং-এ বেয়ারা ছিল—মেয়ে সাপ্লাই করে টু-পাইস কামাতো।”