মিসেস বিশ্বাসের ফ্ল্যাটে যাবার জন্য সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নটবরবাবু বললেন, “মেয়েমানুষ সম্পর্কে সেন্টিমেন্ট-ফেট বাংলা নভেল নাটকেই পড়বেন। আসলে ফিল্ডে কিছুই দেখতে পাবেন না। টাকা দিয়ে মায়ের কাছ থেকে মেয়েকে, ভায়ের কাছ থেকে বোনকে, স্বামীর কাছ থেকে বউকে, বাপের কাছ থেকে বেটীকে কতবার নিয়ে এসেছি টাকার অ্যামাউন্ট ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে গাজেনদের একটও উদ্বিগ্ন হতে দেখিনি। লাস্ট দশ বছরে বাঙালীরা অনেক প্রাকটিক্যাল হয়ে উঠেছে জাতটার পক্ষে এটাই একমাত্র আশার কথা।”
নটবর মিত্তির অমায়িক হাসিতে মুখ ভরিয়ে মিসেস বিশ্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন “কেমন আছেন? অনেকদিন আসতে পারিনি। ক্যালকাটার বাইরে যেতে হয়েছিল।”
“পাঁচজনের আশীর্বাদে” যে ভালোই চলে যাচ্ছে তা মিসেস বিশ্বাস জানিয়ে দিলেন। বললেন, “পুরানো ফ্ল্যাট নতুন করে সাজাতে প্রায় টেন থাউজেন্ড খরচা হয়ে গেলো।”
“এর থেকে নতুন কোনো ফ্ল্যাট ভাড়া নিলে অনেক সস্তা হতো। কিন্তু এই ঠিকানাটা দিল্লী, বম্বে, ম্যাড্রাসের অনেক ভালো ভালো পার্টির জানা হয়ে গেছে। কলকাতায় ট্যুরে এলেই তাঁরা এখানে চলে আসেন। ঠিকানা পাল্টালেই গোড়ার দিকে বিজনেস কমে যাবে।”
ঝকঝকে তকতকে হলঘরটার দিকে তাকিয়ে খুশী হলেন নটবরবাবু। “এ যে একেবারে ইন্দ্রপরী বানিয়ে তুলেছেন!” নটবর মিত্তির প্রশংসা করলেন। “চারটে-পাঁচটা ছোট-ছোট চোর করেছেন, মনে হচ্ছে।”
“জায়গা তো আর বাড়ছে না, কিন্তু মাঝে মাঝে অতিথি বেড়ে যায়। তাই এরই মধ্যে সাজিয়ে-গুজিয়ে বসতে হলো।” ঠোঁট উল্টিয়ে মিসেস বিশ্বাস বললেন, “যা জিনিসের দাম! কিন্তু প্রত্যেক চেম্বারে ডানলপিলোর তোশক দিলুম। নামকরা সব লোক সারাদিনের খাটনির পর পায়ের ধূলো দেন, ওঁদের যাতে কোনো কষ্ট না হয় তা দেখা আমার কর্তব্য। ভগবান যদি মুখ তোলেন, সামনের মাসে দু’খানা চেম্বারে এয়ারকুলার বসাবো।”
“কাকে খোঁজ করছেন? রুমুকে না ঝুমুকে?” মিসেস বিশ্বাস জিজ্ঞেস করলেন। তারপর শান্তভাবে বললেন, “ঝুমু কাস্টমারের সঙ্গে রয়েছে। একটু বসুন না, মিনিট পনেরোর মধ্যে ফ্রি হয়ে যাবে।”
নটবর মিত্তির ঘড়ির দিকে তাকালেন। মিসেস বিশ্বাস একগাল হেসে বললেন, “ঝুমু আপনার ওপর খুব সন্তুষ্ট। সেবার এই গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলে জাপানী গেস্ট দিলেন—ভারি চমৎকার লোক। ঝুমুকে একটা ডিজিটাল টাইমপিস উপহার দিয়েছে—এখানে পাওয়া যায় না। ঝমটাও চালাক। ছোট ভাই আছে, এই বলে সায়েবের কাছ থেকে একটা দামী ফাউনটেন পেনও নিয়ে এসেছে। অথচ জাপানী সায়েব পুরো দাম দিয়েছে একটি পয়সাও কাটেনি।”
“মেয়ে আপনার হীরের টুকরো–সায়েবকে সন্তুষ্ট করেছে, তাই পেয়েছে,” নটবরবাবু বললেন।
মিসেস বিশ্বাস মুখ বেকালেন। “সন্তুষ্ট তো অনেককেই করে। কিন্তু হাত তুলে কেউ তো দিতে চায় না। রুমুর অবস্থা দেখুন না।”
“আপনার বড় মেয়ে তো? কী হলো তার?” নটবরবাবু উদ্বেগ প্রকাশ করলেন।
“বলবেন না। আপনাদের মিস্টার কেদিয়া–পয়লা নম্বর শয়তান একটা। রুমুকে হংকং-এ বেড়াতে নিয়ে যাবার লোভ দেখালেন। এখানে বেশ কয়েকবার এসেছেন। রুমু এবং ঝুমু দুজনের সঙ্গেই ঘণ্টাখানেক করে সময় কাটিয়ে গেছেন। তারপর রুমুর সঙ্গে ভাব বাড়লো! একবার ন’টার শোতে রুমুকে সিনেমা দেখিয়ে এনেছেন। আমাকে দেখলেই গলে যেতেন। ওঁর মাথায় যে এতো দুষ্টমি কী করে বুঝবো? ভদ্রলোক আমাকে বললেন, “বিজনেসের কাজে হংকং যাচ্ছি। রুমুকে দু হপ্তার জন্য ছেড়ে দিন। মেয়ের রোজগারও হবে ফরেন ঘোরাও হবে। হাজার টাকায় রফা হলো। ওখানকার সব খরচা—প্লেন ভাড়া হোটেল ভাড়া উনি দেবেন। আমি তো বোকা—রুমুটা আমার থেকেও বোকা। হতভাগাটার শয়তানী বেচারা বুঝতে পারেনি। বিদেশে যাবার লোভে কচি মেয়েটা লাফালাফি করতে লাগলো। কাজকর্ম বন্ধ রেখে পাসপোর্টের জন্য ছোটাছটি আরম্ভ করলো। কেন মিথ্যে বলবো, কেদিয়ার ট্রাভেল এজেন্ট পাসপোর্টের ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। আমি ভাবলাম, আহা, জানাশোনা ছেলের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণের একটা সুযোগ যখন এসেছে, তখন মেয়েটা সাধ-আহ্লাদ মিটিয়ে অসকে। ক’দিন আমার কাজকর্মের ক্ষতি হয় হোক।”
“হাজার হোক মায়ের প্রাণ তো।” নিজের টাকে হাত বুলিয়ে নটবরবাবু ফোড়ন দিলেন।
নাটকীয় কায়দায় সজল চোখে মিসেস বিশ্বাস এবার বললেন, “মেয়েটাকে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে গিয়ে যা অত্যাচার করেছে না—বেচারার কিছু অবশিষ্ট রাখেনি।”
“কেদিয়া একটা নামকরা শয়তান,” নটবরবাবু খবর দিলেন।
“শয়তান বলে শয়তান! মেয়ের মুখে যদি সব কথা শোনেন আপনার চোখে জল এসে যাবে। আমাকে বুঝিয়ে গেলো, কেদিয়ার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। আমি কোথায় ভাবলাম, দুজনে স্বামী-স্ত্রীর মতো ঘুরে বেড়াবে। তা না, হোটেলে তুলে বন্ধু-বান্ধব ইয়ার জুটিয়ে সে এক সর্বনাশা অবস্থা! মোটামোটা টাকা নিজের পকেটে পরে অসহায় মেয়েটাকে আধঘণ্টা অন্তর ভাড়া খাটিয়েছে। মেয়েটা পালিয়ে আসবার পথ পায় না। ভাগ্যে রিটার্ন টিকিট কাটা ছিল।”
একটু থেমে মিসেস বিশ্বাস বললেন, “আপনি শুনে অবাক হবেন, নিজের রোজগার থেকে রুমুকে একটা পয়সাও ঠেকায়নি। উল্টে বলেছে তুমি তো ফরনে এসেছো!”
“রুমু কোথায়?” নটবর মিটার জিজ্ঞেস করলেন।
“ডাক্তারের কাছে গেছে। চেহারা দেখলে আপনি চিনতে পারবেন না। আমার কী ক্ষতি বুঝুন। এই অবস্থায় কাজে লাগিয়ে মেয়েটাকে তো মেরে ফেলতে পারি না। ভাগ্যে একটা বদলি সিন্ধি মেয়ে পেয়ে গেলাম। লীলা সামতানী—সকালবেলায় একটা স্কুলে পড়ায়। এখন পাশের ঘরে কাস্টমারের সঙ্গে রয়েছে।”