এবার বিরাট এক কাঁচের গেলাসে ডাবের জল খেলেন মিসেস গাঙ্গুলী। বললেন, “আপনাদের দিতে পারলাম না—ঠিক দুটো ডাব ছিল। এটা আমাদের লাইনে ওষুধের মতো। শরীর বাঁচাবার জন্যে কাজে বেরোবার ঠিক আগে খেতে হয়।”
বেরোবার মুখেই কিন্তু গণ্ডগোল হলো। মিসেস গাঙ্গুলীর স্বামী ফিরলেন। অফিস থেকে বেরিয়ে পথে কোথাও মদ খেয়ে এসেছেন। মুখে ভকভক করে গন্ধ ছাড়ছে।
“তুমি কোথায় যাচ্ছ?” বেশ বিরক্তভাবে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক। মিসেস গাঙ্গুলীর হাসি কোথায় মিলিয়ে গেলো। বললেন, “কাজে। খুব তাড়াতাড়ি ফিরবো।”
ভদ্রলোক নেশার ঝোঁকে বললেন, “তোমাকে এতো ধকল সইতে আমি দেবো না, মলিনা। পর পর তিনদিন বেরোতে হয়েছে তোমাকে! আগামীকাল মিস্টার আগরওয়ালা তোমাকে নিতে আসবেন।”
মিসেস গাঙ্গুলী স্বামীকে সামলাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভদ্রলোক রেগে উঠলেন। “শালারা ভেবেছে কী? পয়সা দেয় বলে তোমার ওপর যা খুশী অত্যাচার করবে? কালকে তোমায় রাত দেড়টার সময় ফেরত পাঠিয়েছে। আমি তোমার স্বামী–আমি হুকুম করছি, আজ তোমাকে বিশ্রাম নিতে হবে।”
বিব্রত মিসেস গাঙ্গুলী মত্ত স্বামীকে আবার বোঝাবার চেষ্টা করলেন। বললেন, “এদের কথা দিয়েছি—এরা অসুবিধেয় পড়ে যাবেন।”
রক্তচক্ষু মিস্টার গাঙ্গুলী একবার সোমনাথ ও আরেকবার নটবরবাবুর দিকে তাকালেন। তারপর দাঁতে দাঁত চেয়ে স্ত্রীকে বললেন, “আমি তো ফরেন হইস্কি ছেড়ে দিশী খাচ্ছি। মলিনা। অত টাকা তোমায় রোজগার করতে হবে না।”
অপারগ মিসেস গাঙ্গুলী অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। ক্ষমা চেয়ে বললেন, “আমাকে ভুল বুঝবেন না। ওর মাথায় যখন ভূত চেপেছে তখন ছাড়বে না। এখন যদি আপনাদের সঙ্গে বেরোই—বাড়ি ফিরে দেখবো সব ভেঙ্গে-চুরে ফেলেছে। কী হাঙ্গামা বলুন তো—এসব রটে গেলে আমার যে কী সর্বনাশ হবে ভেবে দ্যাখে না।”
সোমনাথ স্তম্ভিত। জেনেশুনে স্বামী এইভাবে বউকে ব্যবসায় নামিয়েছে। আর সোমনাথ তুমি কোথায় যাচ্ছ? কোনো এক অদর অন্ধকার গুহা থেকে আরেকজন সোমনাথ কাতরভাবে চিৎকার করছে।
কিন্তু সোমনাথ তো এই ডাকে বিচলিত হবে না। যে-সোমনাথ ভালো থাকতে চেয়েছিল তাকে তো সমাজের কেউ বেঁচে থাকতে দেয়নি। সোমনাথ এখন অরণ্যের আইনই মেনে চলবে।
নটবর মিত্রের অভিজ্ঞ মাথায় এখন নানা চিন্তা। টাকের ঘাম মুছে বললেন, “এই জন্যে বাঙালীদের কিছু হয় না। হতভাগা গাঙ্গুলীটা বাড়ি ফিরবার আর সময় পেলো না! কত পত্নীপ্রেম দেখলেন না? তোমার রেস্ট দরকার? তোমায় যেতে দেবো না! আর কি রকম সতী-সাধী স্ত্রী! স্বামী-দেবতার আদেশ অমান্য করলেন না!”
সোমনাথের চিতা, কাজের শুরুতেই বাধা পড়লো। এবার কী হবে?
নটবর নিজেই বললেন, “চলুন চলুন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোলে কাজ হবে না। সময় হাতে নেই। মিস্টার গোয়েঙ্কার কাছে আপনার মানসম্মান রাখতেই হবে!”
২৮. উড স্ট্রীটে এলেন নটবর মিত্র
উড স্ট্রীটে এলেন নটবর মিত্র।
একটা নতুন বিরাট উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির অটোমেটিক লিফটে উঠে বোতাম টিপে দিলেন নটবরবাবু। “দেখি মিসেস চক্রবর্তীকে। আপনি আবার যা সরল, যেন বলে বসবেন না অন্য জায়গায় সাপ্লাই না পেয়ে এখানে এসেছি।” সোমনাথকে সাবধান করে দিলেন নটবরবাবু।
পাঁচতলায় দক্ষিণ দিকের ফ্ল্যাটে অনেকক্ষণ বেল টেপার পর মিসেস চক্রবর্তীর দরজা খুললো। একটা ম্যাড্রাসি চাকর ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ অতিথির দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর কোনোকিছু না বলে ভিতরে চলে গেলো। নটবরবাবু, নিজের মনেই বললেন, “মিসেস চক্রবর্তীর ফ্ল্যাট যেন ঝিমিয়ে পড়েছে।”
এবার প্রৌঢ়া কিন্তু সুদর্শনা মিসেস চক্রবর্তী ঘোমটা দিয়ে দরজার কাছে এলেন। ‘ নটবরবাবুকে দেখেই চিনতে পারলেন। মুখ শুকনো করে মিসেস চক্রবর্তী বললেন, “আপনি শোনেননি? আমার কপাল ভেঙেছে। মেয়েগুলোকে আচমকা পুলিশে ধরে নিয়ে গেলো।”
আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করলেন নটরববাব।।
মিসেস চক্রবর্তী বললেন, “আর জায়গা পেলো না। পুলিশের এক অফিসার রিটায়ার করে পাশের ফ্ল্যাটটা কিনলো। ওই লোকটাই সর্বনাশ করিয়েছে মনে হয়। এতোগুলো মেয়ে ভদ্রভাবে করে খাচ্ছিল।”
গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করলেন নটবর মিত্র। কাঁদ-কাঁদ অবস্থায় মিসেস চক্রবর্তী বললেন, “বাঙালী পুলিশ বাঙালীর রক্ত খাচ্ছে। ভদ্র পরিবেশে সাত-আটটা মেয়ে আমার এই ফ্ল্যাটে প্রোভাইডেড হচ্ছিল। কয়েকটি কলেজের স্টুডেন্টকেও চান্স দিচ্ছিলাম—হপ্তায় দু-তিন দিন দুপুরবেলায় কয়েকঘণ্টা সৎভাবে খেটে মেয়েগুলো ভালো পয়সা তুলছিল। কিন্তু কপালে সহ্য হলো না!”
“গভরমেন্ট পুলিশ এদের কথা যতো কম বলা যায় ততো ভালো,” নটবরবাবু সান্ত্বনা দিলেন মিসেস চক্রবর্তীকে।
একটু থেমে মিসেস চক্রবর্তী বললেন, “নতুন একটা ফ্ল্যাটের খুব চেষ্টা করছি মিত্তির মশাই। কলকাতায় বাড়ি ভাড়ার যা অবস্থা। সায়েবপাড়ায় মাসে দেড় হাজারের কম কেউ কথা বলছে না। আমি মেরে কেটে আটশ পর্যন্ত দিতে পারি।”
নটবরবাবুকেও ফ্ল্যাট দেখবার জন্য অনুরোধ করলেন মিসেস চক্রবর্তী। বিদায় দেবার আগে বললেন, “আবার একটু গুছিয়ে বসি—তখন কিন্তু পায়ের ধূলো পড়া চাই।”
যথেষ্ট হয়েছে। জন্মদিনে আমার জন্যে কী অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছিলে, হে বিধাতা? সোমনাথ এবার ফিরে যেতে চায়। কিন্তু নটবর মিত্তির এখন ডেসপারেট! তাঁর ধারণা সোমনাথের কাছে তিনি ছোট হয়ে যাচ্ছেন। পাক স্ট্রীটের দিকে যেতে যেতে নটবর বললেন, “কলকাতা শহরে আপনাদের আশীর্বাদে মেয়েমানুষের অভাব নেই। মিস সাইমনের ওখানে গেলে এখনই এক ডজন মেয়ে দেখিয়ে দেবে। কিন্তু ওই সব যা-তা জিনিস তো জানা শোনা পার্টির পাতে দেওয়া যায় না। তবে আমি ছাড়ছি না——আমার নাম নটবর মিত্তির। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।”
২৯. মিসেস বিশ্বাসের ফ্ল্যাটের কাছে
মিসেস বিশ্বাসের ফ্ল্যাটের কাছে হাজির হলেন নটবরবাবু। রমা এবং ঝনমা নিজের দই মেয়েকে মিসেস বিবাস ব্যবসায় নামিয়েছেন শুনে সোমনাথ আর অবিশ্বাস করছে না।