কিন্তু সোমনাথের ইচ্ছে নটবর যেন চলে না যান। সোমনাথের অনুরোধ ঠেলতে পারলেন না নটবরবাবু। বললেন, “আমার যে অনেক কাজ! এক নম্বর পার্টির এখনও ব্যবস্থা হলো না।”
সোমনাথ ভেবেছিল কোনো চায়ের দোকানে বসে একটা ঘণ্টা কাটিয়ে দেবে। কিন্তু নটবরবাবু; বললেন, “কোথায় বসে থাকবেন? চলুন, আমার সঙ্গে ঘরে আসবেন।”
নটবরবাবুর সত্যিই দুশ্চিন্ত! বিরক্তভাবে বললেন, “এ-লাইনে বাঙালী মেয়েদের এতো সুনাম—আজকাল এক্সপোর্ট পর্যন্ত হচ্ছে। অথচ আমার ফ্রেন্ডের পাটি অদ্ভুত এক বায়না ধরেছে। পাঞ্জাবী, গুজরাতী, সিন্ধি মেয়ে পর্যন্ত সাপ্লাই করেছি কিন্তু উনি চান বড়বাজারী মেয়ে। কোথায় পাবো বলুন তো? এ-লাইনে সাপ্লাই নেই। অনেক কষ্টে একজন ফ্রেন্ডের কাছে উষা জৈন বলে একটা মেয়ের খবর পেয়েছি। সায়েবপাড়ায় থাকে। যাই একবার দেখে আসি।”
রডন স্ট্রীটে গাড়ি থামলো। নটবরবাবু নাকে নস্যি গুঁজে বললেন, “চলুন না? আপনারও জানাশোনা হয়ে থাকবে।”
সোমনাথ রাজী হলো না। তার মাথা ধরেছে। কপালটা টিপে ধরে সে গাড়ির মধ্যে চুপচাপ বসে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ পরে নটবরবাবু ঊষা জৈনের কাছ থেকে ফিরে এলেন। বিরক্তভাবে বললেন, “ভীষণ ডাঁট মশাই! স্নান করছিলো, আধঘণ্টা বসিয়ে রাখলো। আমি ভাবলুম, না জানি কি ডানাকাটা পরী হবেন! সাজগোজ করে যখন অ্যাপিয়ারেন্স দিলেন তখন দেখলম, মোস্ট অর্ডিনারি। গায়ের রংটা ফর্সা, কিন্তু কেমন যেন টলটলে ঢলঢলে চেহারা কোনো বাঁধনি নেই। মিনিমাম ছত্রিশ বছর বয়স হবে, অথচ আমাকে বললে কিনা সবে পঁচিশে পড়েছে। নিজের টাকে নটবরবাবু একবার হাত বুলিয়ে নিলেন। “ঐ গতর নিয়েই ধরাকে সরা জ্ঞান করছে! মিস্টার রামসহায় মোরে ওঁর এক বন্ধুর সঙ্গে শেয়ারে জয়পর থেকে এই মেয়েকে আট মাস আগে কলকাতায় আনিয়েছিলেন। খরচাপাতি আধা-আধি বখরা হচ্ছিল। বন্ধুর ব্লাডপ্রেসার বাড়ায়, ভদ্রলোককে দমি কমাতে হয়েছে। তাই এখন মেয়েটা কিছু কিছু প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছে। স্বয়ং মিস্টার মোরে টেলিফোনে আমাকে ইনট্রোডিউস করে দিয়েছেন, বলেছেন আমার বুজম ফ্রেন্ড। তবু ঊষা জৈন সাতশ’ টাকার কমে রাজী হলো না। বললো, বম্বেতে নাকি এখন হাজার টাকা রোট। তা মশাই, লঙ্কাতে সোনার দাম চড়া হলে আমার কী বলুন তো? অন্য সময় হলে কোন শালা রাজী হতো—নেহাত ঐ উষা জৈন নামটার জন্যে। আমার কোনো চয়েস নেই। লোকাল মেয়ে হলে ছড়ী একশ টাকা পেতো না।”
২৭. মিসেস গাঙ্গুলী
মিসেস গাঙ্গুলী রেডি হয়েই বসে আছেন। এক ঘণ্টা ধরে সমস্ত দেহে ভদ্রমহিলা যথেষ্ট চুনকাম করেছেন। নাক, চোখ, কপাল, ঠোঁট, কাঁধ, গ্রীবা থেকে আরম্ভ করে হাতের নখ, এমন কি পায়ের পাতায় প্রসাধনের সযত্ন প্রলেপ নজরে আসছে। নটবর মিত্তির রসিকতা করলেন, “আপনাকে চেনাই যাচ্ছে না—দুগ্গা ঠাকরুণ মনে হচ্ছে।”
বেশ খুশী হলেন মিসেস গাঙ্গুলী। বললেন, “গোয়েঙ্কা তো, তাই এরকম সাজলাম। ওরা একটু ঝলমলে জামাকাপড় পছন্দ করে, চড়া রুজ ওদের খুব ভালো লাগে। কিন্তু লিপস্টিক সম্বন্ধে ওদের খুব ভয়—পাঞ্জাবিতে বা গেঞ্জিতে লাগলে অনেক লিপস্টিকের রং উঠতেই চায় না। বাড়িতে বউ-এর কাছে ধরা পড়ে যাবার রিস্ক থাকে।”
মিসেস গাঙ্গুলী এবার সিগারেট ধরালেন। সামান্য একটু ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “কাস্টমারের সামনে আমি কিন্তু স্মোক, করি না। তাই এখন একটা খেয়ে নিচ্ছি।”
“একটা কেন, দশটা সিগারেট খেতে পারেন আপনি—হাতে যথেষ্ট সময় আছে,” নটবর মিত্র বললেন।
সিগারেটে আর একটা টান দিয়ে, কমনীয় অথচ অটট দেহখানি ঈষৎ দুলিয়ে মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “দুশো টাকায় আর চলে না মিত্তির মশাই। জিনিসপত্রের দাম যেরকম বাড়ছে, একবার সাজগোজেই উনিশ-কুড়ি টাকা খরচ হয়ে যায়। এই কাপড় কাচতেই পাঁচ টাকা নিয়ে নেবে—আমি আবার যে কাপড় পরে একবার কাজে বেরিয়েছি তা দুবার পরতে পারি না, ঘেন্না করে। তাছাড়া দামী ল্যাভেন্ডার পাউডার এবং স্যাচেট সেন্ট আমি ব্যাগের মধ্যে নিয়ে যাই। এক-একজন কাস্টমারের গায়ে যা ঘামের গন্ধ! আধ কৌটো পাউডার মাখাবার পরেও দুর্গন্ধে বমি ঠেলে আসে।”
“আপনার কাজের দাম কী আর টাকায় দেওয়া যায়? বিনয়ে বিগলিত নটবর উত্তর দিলেন। “হাই-লেভেলের লোকদের আপনার মতো আপ্যায়ন করতে কে পারবে?”
“তা আপনাদের আশীর্বাদে অনেক বাঘ-সিংহকে বশ করে পায়ের কাছে লুটোপুটি খাইয়েছি!” বেশ গর্বের সঙ্গেই উত্তর দিলেন মিসেস গাঙ্গুলী। “পোষ মানাতে না পারলে আপনারাই বা পয়সা ঢালবেন কেন? একটা কিছু, উদ্দেশ্য আছে বলেই তো পার্টির বিছানায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন।”
“আপনি তো সবই বোঝেন মিসেস গাঙ্গুলী। বিলেত-আমেরিকা হলে আপনার মতো স্পেশালিস্ট লাখ লাখ টাকা রোজগার করতেন,” বললেন নটবর মিত্র।
নাকের ডগায় পাউডার ঘষতে ঘষতে মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “গোয়েঙ্কার কাছ থেকে কোনো খবর-টবর বার করবার থাকলে এখনই বলে দিন। তাহলে ভালো করে মদ-টদ খাওয়াবো।”
হেঁ-হেঁ করে হাসলেন নটবর। “কোনোরকম বিজনেস নেই। স্রেফ সৌজন্যের জন্যে আপ্যায়ন। মিস্টার গোয়েঙ্কা পুরোপুরি স্যাটিসফ্যাকশন পেলেই আমরা খুশী।”
“ফলেন পরিচিয়তে! পনেরো দিনের মধ্যে আমাকে আবার নিয়ে যাবার জন্যে গোয়েঙ্কা যদি আপনাদের ব্যতিব্যস্ত না করে তাহলে আমার নামে কুকুর রাখবেন,” এই বলে মিসেস মলিনা গাঙ্গুলী সোফা ছেড়ে উঠলেন।