খুশী হলেন মিসেস গাঙ্গুলী। দেহ দুলিয়ে বললেন, “মুড়ি-মিছরির তফাত যারা বোঝে তারা আমার কাছে আসে। আপনি তো জানেন, শুধু মচমচে গতর থাকলেই এ-লাইনে কাজ হয় না। আজকালকার মানুষের কত উদ্বেগ, মাথায় তাঁদের কত দুশ্চিন্তা। এইসব মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে দুশ্চিন্তা ভুলিয়ে দেওয়া, আদর আপ্যায়ন করে দু দণ্ডের শাস্তি দেওয়া, একটু প্রশ্রয় দিয়ে খেলায় নামানো কি সোজা কাজ! পেটে একটু বিদ্যে না থাকলে, এসব লাইনে নাম করা যায় না।”
“তা তো বটেই!” মিসেস গাঙ্গুলীর সঙ্গে নটবর একমত হলেন।
ঠোঁট উল্টে মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “আজকাল আনাড়ি যেসব মেয়ে আসছে, তারা পুরষমানুষের মনের খিদের কথাই জানে না। তারা কী করে ভিতরের খবর বার করবে? টাকা খরচ করে যে বিজনেসম্যান গেস্ট পাঠালেন তাঁর কোনো লাভ হয় না।”
নটবর মিত্তির বললেন, “তা তো বটেই।”
ফিক করে হাসলেন মিসেস গাঙ্গুলী। তারপর নটবরকে আক্রমণ করলেন। বললেন, “আপনার তো কোনো পাত্তাই নেই।”
“কাজকর্ম তেমন কই? শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না।” নটবর বেশ বিব্রত হয়ে পড়লেন।
বিশ্বাস করলেন না মিসেস গাঙ্গুলী। মুখে হাত চাপা দিয়ে ছোট্ট হাই তুললেন, তারপর আবার ফিক করে হেসে বললেন, “আমি ভাবলাম মিসেস বিশ্বাসকে সব কাজকর্ম দিচ্ছেন। আমাকে ভুলেই গেলেন।”
“তা কখনো সম্ভব?” নটবরবাবু সুন্দর অভিনয় করলেন। আমাদের বরং আপনাকে কাজ দিতে সঙ্কোচ হয়—আপনি ক্রমশ যে লেভেলে উঠে যাচ্ছেন। খোদ মিস্টার বাজোরিয়ার প্যানেলে ঢুকেছেন আপনি, সে খবর পেয়েছি আমি। আমাদের যেসব পাটি তাদের বেশির ভাগ মড়ি কিনতে চায়। আজ যেমনি শনলাম এই বন্ধুটির মিছরি দরকার, সঙ্গে সঙ্গে আপনার কাছে পাকড়াও করে আনলম। একবার ভাবলমে চিঠি লিখে দিই।”
“না দিয়ে ভালোই করেছেন।” লাল পাথর-বসানো কানের দুল নাড়িয়ে মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “তাজানা-অচেনা লোকের সঙ্গে আমি কথা পর্যন্ত বলি না। যা আজকাল অবস্থা হয়েছে। আপনার মিসেস বিশ্বাস গোপনে পুলিশে খবর দিয়ে, আমাদের জানাশোনা একটা মেয়েকে ধরিয়ে দিয়েছেন। অজন্তা মিত্র খুব ভালো কাজকর্ম করছিল। মিসেস বিশ্বাসের সহ্য হলো না। এত হিংসের কী আছে বাবা? না-হয় তোমার দুজন রেগলার খদ্দের অজন্তার কাছে যাচ্ছিল। কই, আমি তো হিংসে করি না মিসেস বিশ্বাসকে। আমার একটা সায়েব খদ্দেরকে উনি তো কৰ্জা করেছেন।”
নটবর মিত্তির তাড়াতাড়ি কথা শেষ করতে চান। তাই বললেন, “তাহলে আমার এই বন্ধুর?”
“কবে?” হাই তুলে মুখের সামনে তিনবার টসকি দিলেন মিসেস গাঙ্গুলী।
আজকেই শুনে মিসেস গাঙ্গুলী বিশেষ উৎসাহিত বোধ করলেন না। বললেন, “এ যে ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে হয়ে গেলো, মিত্তির মশাই। আজ একটু বিশ্রাম নেবো ভাবছিলাম। পর পর কদিন বড় বেশি খাটাখাটনি চলেছে।”
“আজকের দিনটা চালিয়ে দিন।” অনুরোধ করলেন নটবর মিত্তির। “কাছাকাছি ব্যাপার।”
বুকের আঁচল সামলাতে সামলাতে মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “বেশি রাতের কাজকৰ্ম্ম আজকাল নিই না, নটবরবাবু। উনি বিরক্ত হন।
এবার খুশী হলেন নটবরবাবু “রাতের ব্যাপার হলে আপনাকে বলতামই না। পার্টি নিজেই দশটার মধ্যে ফাঁকা হয়ে যাবে।”
এবার টাকার অঙ্কটা জানতে চাইলেন নটবরবাবু।
‘বসবেন কে?” সুগিঠত দেহটি পাতলা কাপড় দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে প্রশ্ন করলেন . মিসেস গাঙ্গুলী।
“খুবই ফার্স্ট ক্লাস ভদ্রলোক—আমাদের ছোট ভাই-এর মতো। মিস্টার গোয়েঙ্কা।”
মুখ বেকালেন মিসেস গাঙ্গুলী। “লোকগুলো বড় পাজী হয়।”
“যা ভাবছেন—তা মোটেই নয়। কার্তিকের মতো চেহারা। অতি অমায়িক ভদ্রলোক।”
মিসেস গাঙ্গুলী বললেন, “গেস্ট হাউস বা বাড়ি হলে দুশো টাকা। এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে এবং পৌঁছে দিতে হবে। হোটেল হলে কিন্তু তিরিশ টাকা বেশি লাগবে, আগে থেকে বলে রাখছি।”
“আপনার সব কথা মেনে নিচ্ছি, মিসেস গাঙ্গুলী। আপনি তো জানেন আমি দরদাম পছন্দ করি না। কিন্তু ওই হোটেলের জন্য রেট বাড়িয়ে দেওয়াটা কেমন যেন লাগছে।”
রেগে উঠলেন মিসেস গাঙ্গুলী। ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “হোটেলে আমাদের বাড়তি খরচ আছে, নটবরবাবু। অকট্রয় দিতে হয়। একদিনের কাজ তো নয়—দারোয়ান থেকে আরম্ভ করে ম্যানেজারবাবু পর্যত হোটেলের সবাইকে সন্তুষ্ট করতে তিরিশ টাকা লেগে যায়। ওরা আমাদের মুখ চিনে গেছে-বিনা কাজে কোনো গেস্টের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও বিশ্বাস করে না। আজ যদি টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট না করি, তাহলে আগামীকাল হোটেলে কতেই দেবে না। টকতে দিলেও, ঘরে গিয়ে হাঙ্গামা বাধাবে। আগে থেকে বলে রাখা ভালো—না হলে অনেকে ভাবে, তালে পেয়ে তিরিশটা টাকা ঠকাচ্ছি।”
ঘড়ির দিকে তাকালেন মিসেস গাঙ্গুলী। জিজ্ঞেস করলেন, “একটু চা খাবেন?”
সোমনাথ রাজী হলো না। নটবরবাবু বললেন, “আরেকদিন হবে। শুধু চা কেন লুচি মাংস খেয়ে যাবো। মিস্টার গাঙ্গুলীকে বলবেন, পছন্দ মতো বাজার করে রাখতে।”
ফিক করে হাসলেন মিসেস গাঙ্গুলী। তারপর বললেন, “তাহলে ঘণ্টাখানেক পরে আসন। আমি তৈরি হয়ে নিই।”
সোমনাথকে সঙ্গে নিয়ে নটবর মিত্র সার্কুলার রোডে এসে দাঁড়ালেন। নটবর মিত্র এবার বিদায় নিতে চান। সোমনাথকে বললেন, “আপনার সমস্যা তো সমাধান হয়ে গেলো। ঘণ্টাখানেক পরে এসে মিসেস গাঙ্গুলীকে নিয়ে সোজা গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলে চলে যাবেন।”