“নাউ!” মিস্টার নটবর টাকে হাত রাখলেন। এবার স্পেশিফিকেশন। আমার বন্ধুর পাটি যা পেশিফিকেশন দিয়েছে, তাতে আমি তো মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি। গোয়েঙ্কাজীর পছন্দ কী বলুন?”
এবার সত্যিই বিরক্ত হলেন নটবর মিটার। “না মশাই, আপনার দ্বারা কিছু হবে না। বিজনেস লাইন ছেড়ে দিন। একজন সম্মানিত অতিথিকে আপ্যায়ন করবেন, অথচ তাঁর পছন্দ-অপছন্দ জেনে নিলেন না? যে লোক কাটলেট ভালোবাসে তাকে কমলালেবু, দিলে সে কি পছন্দ করবে? এখন ভদ্রলোককে কোথায় পাই। ফোন করেও তো ধরা যাবে না।”
দুরূহ সমস্যার সমাধান নটবর মিটার নিজেই করলেন। বললেন, “কথাবার্তা যতটকু শুনেছি, তাতে মনে হয় ভদ্রলোকের গাউনে রচি নেই—শাড়ির দিকেই ঝোঁক। জাতের কথা আমি মোটেই ভাবছি না। এই একটা ব্যাপারে নিজের জাতের ওপর টান নেই গোয়েঙ্কাজীদের। পছন্দসই বেঙ্গলী গাল পেলে খুব খুশী হবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো হাল্কা না ভারি? খুব ডিফিকাল্ট কোশ্চেন! এই পয়েন্টে বোকামি করেই তো শ্রীধরজী সেবার ফিফটি থাউজেন্ড রপিজের অড়ার হারালেন। পারচেজ অফিসার একটু সেকেলেপন্থী স্বাস্থ্যবতী মেয়েমানুষ পছন্দ করে। উনি সেসব না বুঝে নিয়ে গেলেন আধুনিকা রত্না সাহাকে—একেবারে গাঁজার ছিলিমের মতো রোগা চেহারা, ফরাসী সাহেবরা যা প্রেফার করে। রত্নার বত্রিশ সাইজের জামার দিকে একবার নজর দিয়েই পার্টি বেকে বসলো—বললো, ছেলে না মেয়ে বুঝতে পারছি না, এখন খুব ব্যস্ত আছি, হঠাৎ একটা মিটিং পড়ে গেছে, পরে দেখা হবে। গেলো অর্ডারটা। মাঝখান থেকে রত্না সাহাকেও টাকা গুনতে হলো শ্রীধরজীর। আবার শাঁসালো মেয়েমানুষে প্রচণ্ড অরুচি এমন পাটিও যথেষ্ট দেখেছি। তারা কঞ্চির মতো সঙ্গিনী চায়।”
সোমনাথের মাথা ধরে গেলো। ঘাড়ের কাছটা দপদপ করছে। চিন্তিত বিরক্ত নটবর বললেন, “ভেবে আর কী হবে? চলুন এনটালির দিকে। রিস্ক নেওয়া যাক। মলিনা গাঙ্গুলীর চেহারা মাঝামাঝি। রোগাও না মোটাও না। আপার বডিটা একটু হেভি, কিন্তু খুব টাইট গোয়েঙ্কার অপছন্দ হবে না।”
গাড়ি চলছে। ধর্মতলা ও চৌরঙ্গীর মুখে দুর থেকে সোমনাথ যাকে দেখতে পেলো তাতে তার মুখ কালো হয়ে উঠলো। অনেকগুলো বই হাতে তপতী বাসের জন্যে অপেক্ষা করছে নিশ্চয় কনস্যুলেট লাইব্রেরি থেকে বই নিয়েছে। তপতী বোধহয় সোমনাথকে লক্ষ্য করেছে—না হলে অমনভাবে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে কেন?
সোমনাথ দ্রুত উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। ব্যাপারটা নটবর মিত্তির দেখলেন এবং রসিকতা করলেন, “কী মিস্টার ব্যানার্জি? মেয়েমানুষেরা কি বাঘ? অমনভাবে ঘামছেন কেন? বাস স্ট্যান্ডের এক মহিলা আপনার দিকে যেভাবে তাকালেন। এককালে আমাদেরও সময় ছিল! এখন এই চাপাটির মতো টাক পড়ায় কেউ আর ফিরে তাকায় না।”
২৬. ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের কাছে
ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের কাছে হলদে রংয়ের একতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতে বললেন নটবর মিত্র। নিচু গলায় সোমনাথকে বললেন, আপনি গাড়িতেই বসুন। একেবারে ভদ্রলোকের পাড়া। কারুর সন্দেহ হলেই মুশকিল। মিসেস গাঙ্গুলীও জেনুইন ফল গেরস্ত। স্বামী কর্পোরেশনের ক্লাক—একটু মদ খাবার অভ্যাস আছে, তাই মাইনের টাকায় চালাতে পারেন না।”
সোমনাথ গাড়িতে বসে রইলো। মিস্টার মিটার দরজার কলিং বেল টিপলেন এবং ভিতরে ঢকে গেলেন। একটু পরে হাসি মুখে বেরিয়ে এসে সোমনাথকে বললেন, “চলুন। মিসেস গাঙ্গুলীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই!” নটবর এবার ফিসফিস করলেন, “একেবারে টাইট নারকুলে বাঁধাকপির মতো বক—গোয়েঙ্কার খুব পছন্দ হবে।”
নটবরের পিছন পিছন সোমনাথ ঘরের মধ্যে ঢুকলো। পরিপাটি পরিচ্ছন্ন বসবার ঘর। সফট-লেদার মোড়া নরম সোফাসেটে সোমনাথ বসলো। ঘরের এককোণে কিছু বাংলা এবং ইংরিজী বই। দেওয়ালে দু-তিনজন শ্রদ্ধেয় মনীষীর ছবি। এক কোণে একটা টাইমপিস ঘড়ি। এবং তার পাশেই নিকেল-করা সুদৃশ্য ফোল্ডিং-ফ্রেমে মিসেস গাঙ্গুলী ও আর-এক ভদ্রলোকের ছবি। নিশ্চয় মিস্টার গাঙ্গুলী হবেন।
মিসেস গাঙ্গুলীর বয়স একত্রিশ-বত্রিশের বেশি নয়। বেশ লম্বা এবং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। মখটি বেশ সরল-গহবধুর মতোই। কোথাও পাপের ছায়া নেই। মলিনা বোধহয় সবে ঘুম থেকে উঠেছেন। কারণ চোখদুটোতে এখনও দিবানিদ্রার রেশ রয়েছে। হাল্কা নীল রংয়ের ফল ভয়েল শাড়ি পরেছেন মিসেস গাঙ্গুলী—সেই সঙ্গে চোলি টাইপের টাইট সাদা সংক্ষিপ্ত ব্লাউজ, ফলে বুকের অনেকখানি দশ্যমান।
ভদ্রমহিলা আড়চোখে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। সোমনাথ চোখ নামিয়ে নিলো। নটবর বললেন, “ইনিই আমার বন্ধু, মিস্টার ব্যানার্জি। বুঝতেই পারছেন।”
মিসেস গাঙ্গুলী হাত দুটো তুলে এমনভাবে আলতো করে নমস্কার করলেন যে আন্দাজ করা যায় বালিকা-বয়সে তিনি নাচের চর্চা করতেন।
“এবার একটা টেলিফোন নিন, মিসেস গাঙ্গুলী। টেলিফোন ছাড়া আপনাকে আর মানায় না। অভিযোগ করলেন নটবরবাবু।
ফিক করে হাসলেন মিসেস গাঙ্গুলী। ডান কাঁধে ব্রা-এর যে স্ট্র্যাপ উঁকি মারছিল, সেটা ব্লাউজের মধ্যে ঠেলে দিতে দিতে ভদ্রমহিলা বললেন, “ওঁর ইচ্ছে নয়। বলেন, ফোন হলেই তোমাকে সব সময় জ্বালাবে। আজেবাজে লোকের তো অভাব নেই।”
নটবরবাবু বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আজেবাজে লোকের সঙ্গে আপনার কাজ কোথায়? আমি তো জানি, একদম হাইয়েস্ট লেভেলে খুব জানাশোনা পার্টি ছাড়া আপনাকে পাওয়াই যায় না।”