সেই সব দিনের কথা ভেবে দ্বৈপায়নের মনে হাসি আসছিল। প্রতিভার খুব বিশ্বাস ছিল ছোটছেলের ওপরে। সোমনাথ মায়ের কথা শুনতো। ছোট বয়স থেকেই সোমনাথ খুব শান্ত। পড়ায় বসাবার জন্যে মাকে কখনও বকাবকি করতে হতো না। সন্ধ্যা হওয়ামাত্র হাতপা ধুয়ে পড়ার টেবিলে চলে যেতে খোকন। নিজের মনে পড়ে যেতো, মা ডাকলে তবে উঠে এসে ঢায়ের পেয়ালা নিতে। রাত্রে খাবার তৈরি হলে প্রতিভা ডাকতেন, বই-পত্তর গুছিয়ে রেখে খোকন খেতে বসতো। প্রতিভা বলতেন, “খোকনকে নিয়ে আমাকে একটুও ভাবতে হবে না।”
হাসলেন দ্বৈপায়ন। এখন যত ভাবনা সেই খোকনকে নিয়েই। তবে প্রতিভা একদিকে ঠিকই বলেছিলেন। সোমনাথের ভাবনা প্রতিভাকে একটও ভাবতে হচ্ছে না। সমস্ত দায়দায়িত্ব দ্বৈপায়নের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তিনি অসময়ে বিদায় নিয়েছেন।
ওপরের ব্যালকনিতে চায়ের কাপে দ্বৈপায়ন যখন চুমুক দিলেন তখন সোমনাথ একতলায় নিজের বিছানায় আর একবার পাশ ফিরে শুলো।
সোমনাথেরও এই মুহূর্তে মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। মা সত্যিই আদরের ছোটছেলের ওপর অগাধ আস্থা রেখেছিলেন। মায়ের ভরসা ছিল, ছোটছেলে বাড়ির সেরা হবে। তাই সেবার যখন সেই দাড়িওয়ালা শিখ গণক্তার টালিগঞ্জের বাড়িতে যা-তা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেলো তখন মা ভীষণ চটে গেলেন। সেই তারিখটা সোমনাথ বলে দিতে পারে কারণ সেদিন ছিল সোমনাথের জন্মদিন। হাতে কিছু কাগজপত্তর নিয়ে শিখ গণৎকার তাদের দরজায় এসে কলিং বেল টিপেছিল।
বাড়িতে তখন মা এবং সোমনাথ ছাড়া আর কেউ ছিল না। দাদারা কলেজ বেরিয়েছে, বাবা অফিসে। সোমনাথ শুধু স্কুলে যায়নি জন্মদিনে মায়ের কাছে আবদার করেছিল, “আজ তোমার কাছে থাকবো মা।” মা এমনিতে বেজায় কড়া কিন্তু ছোটছেলের জন্মদিনে নরম হয়েছিলেন। বেল বাজানো শুনে মা নিজেই দরজা খুলতে এসে গণৎকারের দেখা পেলেন।
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে গণৎকার চটপট বললো, “তুই গণনায় বিশ্বাস করিস না। কিন্তু তোর মুখ দেখে বলছি আজ তোর খুব আনন্দের দিন।”
সেই কথা শুনেই মায়ের খানিকটা বিশ্বাস হলো। গণকঠাকুরকে বাইরের ঘরে বসতে দিলেন। বললেন, “আমার হাত দেখাবো না। আমার ছেলের ভাগ্যটা পরীক্ষা করিয়ে নেবো।”
এই বলে মা সোমনাথকে ডাকলেন।
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, বিড়বিড় করে কী সব হিসেব-পত্তর সেরে শিখ বললো, “বেটী তোর তিনটে ঘড়া আছে।” ঘড়া বলতে গণকঠাকুর যে ছেলেদের কথা বলছেন তা মায়ের বুঝতে দেরী হলো না। গণনা মিলে যাচ্ছে বলে একটু আনন্দও হলো। কিন্তু এবার গণৎকার চরম বোকামি করে বসলো। বললো, “তোর প্রথম দুটো ঘড়া সোনার—আর ছোটটা মাটির।”
শোনা মাত্রই মায়ের মেজাজ বিগড়ে গেলো। ইতিমধ্যে সোমনাথ সেখানে এসে পড়েছে। কিন্তু মা তখন গণকঠাকুরকে বিদায় করছেন, বলছেন, “ঠিক আছে, আপনাকে আর হাত দেখতে হবে না।”
গণকের কথা মা বিশ্বাসই করতে চাননি। তাঁর ধারণা, তাঁর তিনটে ঘড়াই সোনার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হলো?
সোমনাথ আর একবার পাশ ফিরলো। একটা মশা পায়ের কাছে জ্বালাতন করছে। অনেকগুলো দুশ্চিন্তা মাথার ভিতর জট পাকাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে মশার মতো পোঁ-পোঁ আওয়াজ করছে। চাকরির বাজারে কী যে হলো—এতো চেষ্টা করেও সামান্য একটা কাজ জোটানো গেলো না।।
সোমনাথ হয়তো বড়দা এবং ছোটদার মতো ব্রিলিয়ান্ট নয়, হয়তো সে স্কুল ফাইনালে ওদের মতো ফার্স্ট ডিভিসন পায়নি। কিন্তু যেসব ছেলে সেকেন্ড কিংবা থার্ড ডিভিসনে পাস করেছে তাদের কি এদেশে বাঁচবার অধিকার নেই? তারা কি গঙ্গার জলে ভেসে যাবে?
গত আড়াই বছরে অন্তত কয়েক হাজার চাকরির অ্যাপ্লিকেশন লিখেছে সোমনাথ কিন্তু ওই আবেদন-নিবেদনই সার হয়েছে। আজকাল, সত্যি বলতে কি চাকরির ব্যাপারটা আর ভাবতেই ইচ্ছে করে না সোমনাথের। কোনো লাভ হয় না, মাঝখান থেকে মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়।
আবার একটু ঘুমের ঘোর আসছে সোমনাথের।
সোমনাথের মনে হচ্ছে চাকরির উমেদারী এবার শেষ হলো। ধবধবে সাদা শার্ট-প্যান্ট এবং নীল রংয়ের একটা টাই পরে সেমিনাথ প্রখ্যাত এক বিলিতী কোম্পানির মিটিং রুমে বসে আছে। দিশী সায়েবরা ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। তাঁরা একের পর এক প্রশ্নবাণ ছাড়ছেন, আর সোমনাথ অবলীলাক্রমে সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। একজন অফিসার তারই মধ্যে বললেন, “মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি রিটন পেপারে ফরেন ক্যাপিটাল সম্পর্কে খুব সুন্দর উত্তর লিখেছেন। এ-বিষয়ে আরও দু-একটা কথা আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।” ভদ্রলোকের প্রস্তাবে সোমনাথ একটও ভয় পাচ্ছে না। কারণ ফরেন ক্যাপিটাল সম্পর্কে সব রকম সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর সোমনাথের মখস্থ আছে।
ইন্টারভিউ শেষ করে সৌজন্যমূলক ধন্যবাদ জানিয়ে সোমনাথ বেরিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় সুন্দরী এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সেক্রেটারী মিটিং রুমের বাইরে ওর পথ আটকালো। বললো, “মিঃ ব্যানার্জি, আপনি চলে যাবেন না-রিসেপশন হল-এ একটু অপেক্ষা করুন।”
মিনিট পনেরো পরে সোমনাথের আবার ডাক হলো। পার্সোনেল অফিসার অভিনন্দন জানালেন এবং করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “বুঝতেই পারছেন, আমরা আপনাকেই সিলেক্ট করেছি। দু-একদিনের মধ্যেই জেনারেল ম্যানেজারের সই করা চিঠি পাবেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়া মাত্রই আমাদের জানিয়ে দেবেন, কবে কাজে যোগ দিতে পারবেন।”