আড়চোখে নববিবাহিতা পত্রবধুর দিকে সকৌতুকে তাকিয়ে দ্বৈপায়ন বলেছিলেন, “বউমাকে আমি সালিশী মানছি।”
তারপর আস্তে-আস্তে অর্ধাঙ্গিনীকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, “চাকরির জন্যে পরীক্ষায় পাস করা ছাড়াও আর একটা কাজ করেছিলাম তোমাকে এ-বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম।”
কমলা আন্দাজ করেছিল, বাবার এই সগর্ব ঘোষণায় মা খুব খুশী হবেন। হয়তো পত্রবধুর সামনে লজ্জা পাবেন। কমলা তাই কোনো একটা ছুতোয় সেখান থেকে সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ী কেউ যেতে দিলেন না। তাঁদের মেয়ে নেই—তাই কমলার ওপর স্নেহ একটু বেশি।
চোখে-মুখে আনন্দের ভাবটা ইচ্ছে করে চাপা দিয়ে প্রতিভা দেবী ঝগড়ার মেজাজে বলেছিলেন, “একেবারে বাজে কথা।” তারপর কমলার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “এর কোনো কথা বিশ্বাস কোরো না বউমা। তুমি শুনে রাখো, যদি কারুর জন্যে এ-বাড়িতে বউ হয়ে থাকতে পারি, সে আমার পুঁটে মামার জন্যে। দেড় বছর মামা ওঁর পিছনে লেগেছিলেন, আর উনি নানান ছুতোয় মামাকে অন্তত দুশোবার ঘুরিয়েছেন। পুঁটে মামার অসীম ধৈর্য না থাকলে আমার বিয়েই হতো না। আমি তখনই ঠিক করেছিলাম, আমার ছেলের বিয়ের সময় মেয়ের বাবাকে একেবারেই ঘোরাবো না।”
“করেছেনও তো তাই,”, কমলা এবার শাশুড়ীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। এ-বাড়িতে বধূ, হিসাবে মেয়েকে পাঠাতে তার বাবা-মাকে মোটেই কষ্ট করতে হয়নি। সামান্য এক সপ্তাহের মধ্যে সব কথাবার্তা পাকাপাকি হয়েছিল।
প্রতিভা দেবী বলেছিলেন, “তোমার বিয়ের ব্যাপারে উনি অবশ্য কথার অবাধ্য হননি। ভোম্বল একবার আপত্তি তুলতে গিয়েছিল, একটু সময় দাও, ভেবে দেখি। কিন্তু এমন বকুনি লাগিয়েছিলাম যে আর কথা বাড়াতে সাহস পায়নি। কলেজে অমন শক্ত শক্ত সব পরীক্ষায় উত্তর লিখতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় দেয় না—আর সামান্য একটা বিয়ের ব্যাপারে মতামত জানাতে হাজার দিন সময় চাই কেন?”
“বিয়েটা সামান্য নয়, প্রতিভা,” দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি পুত্রবধূর সামনেই গৃহিণীর সঙ্গে রসিকতা করেছিলেন।
প্রতিভা এরপর অরিজিন্যাল বিষয়ে ফিরে এসেছিলেন। বলেছিলেন, “বিয়ের তিরিশ বছর পরে রহস্যটা বুঝে তো লাভ নেই, এখন বাড়ি সম্বন্ধে যা বলছি শোনো। তোমাকে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। তোমার ব্যাঙ্কের পাশ বই আমার কাছেই আছে। প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং ইনসিওর থেকে কত টাকা পাবে তাও আমি পলিনকে দিয়ে হিসেব করিয়েছি। ভোম্মলের নকশা অনুযায়ীই বাড়ি হবে। ছোট বাড়ি হোক, লোক যেন দেখলে খুশী হয়। বউমাকে তুমি যতই নিজের দলে টানো, আমি আর ভোম্বল যা করবো তাই হবে। তোমার কোনো কথায় কখনও কান দিইনি, এখনও দেবো না।”
দ্বৈপায়ন হেসে বলেছিলেন, “ঠিক আছে। বাড়িতে যখন আমার কোনো কথাই চলবে না, তখন বাড়ির বারান্দায় বসে যাতে নিজের কথা ভাবতে পারি এমন ব্যবস্থা যেন থাকে।”
রিটায়ার করে তুমি যাতে নিজের খেয়াল মতো বসে থাকতে পারো তার ব্যবস্থা তো রাখা হয়েছে—বারান্দা নয়, দোতলায় রীতিমতো ব্যালকনি তৈরি হবে তোমার জন্যে।” প্রতিভার কথাগুলো এখনও কানে বাজছে দ্বৈপায়নের। সেই বাড়ি উঠলো, সেই ব্যালকনি রয়েছে—শুধু প্রতিভা নেই। দ্বৈপায়নের রীতিমতো সন্দেহ হয়, এমন যে হবে প্রতিভা জানতো। তাই আগে থেকে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
ব্যালকনি থেকে দ্বৈপায়ন আবার যোধপর পার্কের রাস্তার দিকে তাকালেন। পথচারীরা ওঁর দিকে নজর দিয়ে হয়তো কত কী ভাবছে। আন্দাজ করছে, বদ্ধ ভদ্রলোক সব দিকে সফল হয়ে এখন কেমন নিশ্চিত মনে স্বোপার্জিত অবসরসখ ভোগ করছেন।
এ-রকম ভুল বুঝবার যথেষ্ট অবকাশ আছে। বিশেষ করে বাড়ির সামনে সুদৃশ্য বোর্ডে নামের তালিকা দেখলে। নেমপ্লেটে প্রথমেই দ্বৈপায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম লেখা—সকলেই জানে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস থেকে অবসরপ্রাপ্ত। তারপরেই সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, খড়্গপুরের এম-ই। তারপর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট। এখন তো চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্টদেরই যুগ। হিসাবেই তো শিব! অভিজিতের পরে সোমনাথের নামটাও ওখানে লেখা আছে।
ছোটছেলে সোমনাথের কথা মনে আসতেই দ্বৈপায়ন কেমন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। যোধপর পার্কের এই ছবির মতো সুখের সংসারে ছোট ছেলেটাই ছন্দপতন ঘটিয়েছে। সুব্রত ও অভিজিৎ দুজনেই স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষায় ভালো ফল করেছিল। সুব্রত তো অঙ্কে লেটার পেয়েছিল। অভিজিৎ ছোকরার নাম যে স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষায় স্কলারশিপ-লিস্টে উঠবে তা দ্বৈপায়ন বা প্রতিভা দেবী কেউ কল্পনা করতে পারেননি। অথচ অভিজিৎ সম্বন্ধে প্রতিভার বেশি চিন্তা ছিল-ছোকরা মাত্রাতিরিক্ত আড্ডা দিতে, সময়মতো পড়াশোনায় বসতো না, বুঁদ হয়ে রেডিও সিলোনে হিন্দী সিনেমার গান শুনতো।
অভিজিৎকে প্রতিভা বলতেন, “তোর কপালে অনন্ত দুর্গতি আছে। গেরস্ত বাঙালীর ঘরে পড়াশোনার জোরটাই একমাত্র জোর—আর কিছুই নেই তোদের! তুই এখন লেখাপড়া করছিস না, পরে বুঝবি।”
অভিজিৎ, ওরফে কাজল ফিকফিক করে হাসতো। কোনো কথাই শুনতো না। পরীক্ষার রেজাল্ট যখন বেরল তখন প্রতিভা বিশ্বাসই করতে পারেন না, কাজল স্কলারশিপ পেয়েছে। ছেলেটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে পুরানো কায়দায় ঠোঁট টিপে হাসছিল।
প্রতিভা বলেছিলেন, “দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় কাছে আয়।” তারপর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়েছিলেন। লজ্জা পেয়ে কাজল তখন মায়ের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। প্রতিভা বলেছিলেন, “শুধু শুধু আমাকে এতোদিন ভাবিয়ে কষ্ট দিলি।”