কমলা বললো, “সকালবেলায় একটু বেড়ানো অভ্যেস করুন না।”
দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি বললেন, “করবো ভাবছি। কিন্তু শরীরে ঠিক জুত পাই না।”
শ্বশুরের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলো না কমলা। তাঁকে মনোবল দেবার জন্যে সে বললো, “আমার বাবাও প্রথমে বেরোতে চাইতেন না। এখন কিন্তু সকালে বেড়িয়ে খুব আরাম পাচ্ছেন। বাতের ব্যথা কমেছে। খিদে হচ্ছে।”
দ্বৈপায়ন বললেন, “দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বসো না বউমা।”
এক সময় শ্বশুরমশায় গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কারুর সঙ্গে বড় একটা কথা বলতেন না। কিন্তু স্ত্রী বিয়োগের পর কী যে হলো—বেশ পাল্টে গেলেন। এখন বড় বউমার সঙ্গে অনেক কথা বলেন প্রায় আড্ডা জমিয়ে ফেলেন মাঝে মাঝে।
আট বছর আগেও এই বাড়ির সর্বময়ী কত্রী ছিলেন প্রতিভা দেবী। কাজে কর্মে ও প্রাণোচ্ছল কথাবার্তায় তিনি একাই ব্যানার্জি পরিবারের সমস্ত কিছু পরিপূর্ণ রেখেছিলেন। দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি নিজেই কমলাকে বলেছিলেন, “তোমার শাশুড়ী যে বলতেন এ-বাড়িতে তিনিই ভাগ্যলক্ষ্মীকে এনেছেন তা মোটেই মিথ্যে নয়।”
এর পরেই শ্বশুরমশায় ড়ুবে যেতেন পুরানো দিনের গল্পে। কমলাকে বলতেন, কেমন করে ওঁদের বিয়ে হলো—ছোটবেলায় প্রতিভা কী রকম একগয়ে ছিলেন—দ্বৈপায়নের সঙ্গে ঝগড়া হলে শাশুড়ীর কাছে কীভাবে স্বামীর নামে লাগাতেন।
আজও বাবা বোধহয় বউমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। আর এই ভোরবেলাটাই ওঁর যত কথা বলার সময়। চায়ে চুমুক দিয়ে দ্বৈপায়নের খেয়াল হলো বউমার নিজের মুতে চায়ের পেয়ালা নেই। ব্যস্ত হয়ে তিনি বললেন, “ওহো, তোমাদের চা বোধহয় নিচের টেবিলে ঠাণ্ডা হচ্ছে। আমার মনে থাকে না যে প্রথমে আমার জন্যে বিনা চিনিতে চা তৈরি করো। তারপর অন্যদের চা-এ চিনি মেশানো হয়। তুমি বরং চায়ের হাঙ্গামা শেষ করে এসো বউমা। ইচ্ছে করলে নিজের কাপটা এনে এখানে বসতে পারো।”
কমলা বললো, “না-হয় একটু দেরি হবে। এখনও তো কেউ ওঠেনি।”
বাবা রাজী হলেন না। বললেন, “না, মেজ বউমা কি চয় তোমার জন্যে বসে আছে। তোমার শাশুড়ী এই জন্যে আমাকে বকাবকি করতেন। বলতেন, সংসারটা কেমনভাবে চলছে তুমি মোটেই খোঁজ রাখো না। তুমি নিজের খেয়ালেই বদ হয়ে থাকো।”
শ্বশুরের কথা অমান্য করতে পারলো না কমলা। বাবাকে যে কমলা খুব ভালোবাসে তা ওর ভাবভঙ্গি দেখুলেই বোঝা যায়। বাড়ির সবার সঙ্গেই দ্বৈপায়নের একটু দূরত্ব আছে–যে একজন কেবল খুব কাছাকাছি চলে আসতে পারে সে কমলা।
আরামকেদারায় অর্ধশায়িত অবস্থায় দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি অপসরমান কমলার দিকে সস্নেহে তাকিয়ে রইলেন। শুধু নামে নয়, আসল কমলাকেই একদিন প্রতিভা পছন্দ করে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। প্রতিভা বোধহয় জানতেন তিনি এখানে চিরদিন থাকবেন না।
যোধপর পার্কের পূব-পশ্চিমমুখো রাস্তাটা এই বারান্দা থেকে পুরো দেখা যায়। দু-একজন পথচারী গভরমেন্টের দুধের বোতল হাতে এই পথ দিয়ে যেতে-যেতে ব্যালকনির আরামকেদারায় সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বৈপায়নকে লক্ষ্য করছে। এই বাড়ির মালিককে তারা বোধহয় হিংসে করছে। বাড়িটা ছোট হলেও ছিমছাম—সর্বত্র রুচির পরিচয় ছড়িয়ে আছে। সে-কৃতিত্ব অবশ্য দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির নয়—প্রতিভা এবং বড় ছেলে সুব্রতর। আই-আই-টিতে এক মাস্টারমশায়কে দিয়ে সব্রত নকশা আঁকিয়েছিল। দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি ভেবেছিলেন বিলেতফেরত আর্কিটেক্টের ওই নকশা অনুযায়ী বাড়ি করতে অনেক খরচ লাগবে রাজ্য সরকারের সাধারণ চাকরি করে এতো টাকা কোথায় পাবেন তিনি?
প্রতিভা কিন্তু দ্বৈপায়নের কোনো আপত্তি শোনেননি। নির্দ্ধিধায় স্বামীকে মুখ-ঝামটা দিয়েছিলেন। ওঁরা তখন থাকতেন টালিগঞ্জের একটা সরকারী রিকুইজিশনকরা ফ্ল্যাটবাড়িতে। প্লান দেখে দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি বলেছিলেন, “ভোম্বল, এসব বাড়ি বিলেত আমেরিকায় চলে। কলকাতা শহরে জমিই কিনতে পারতাম না-নেহাত সরকারী কো-অপারেটিভ থেকে জলের দামে আড়াই কাঠা দিলো তাই। সে দামটাও তো শোধ করেছি মাসে মাসে মাইনে থেকে।
প্রতিভা বলেছিল, “তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো কেন? আমি আর ভোম্বল যা পারি করবো। ভোম্বল তো তোমার মতো আনাড়ি নয়—ভালোভাবে আই-আই-টি থেকে পাস করেছে।’
কমলার তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে। তখন থেকেই সে একটু বশরের দিকে ঝকে কথা বলে। সে বলেছিলো, “টাকাটা তো বাবাকেই বার করতে হবে।” শাশুড়ীকে বলেছিল, “বাবার কত অভিজ্ঞতা। কত আদালতে কত লোককে দেখেছেন।”
বউমার সঙ্গে প্রতিভা একমত হতে পারেনি। জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, “শুধু বস্তা বস্তা রায় লিখেছে কোর্টে বসে—কিন্তু কোনো কাণ্ডজ্ঞান হয়নি। সারাজন্ম আমাকেই চালিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে তোমার শ্বশুরমশাইকে। যোধপর পার্কের এই জমিটুকুও কেনা হতো না—যদি-না পলিন রায়ের কাছে খবর পেয়ে আমি রাইটার্স বিল্ডিংস-এ ওঁকে পাঠাতাম। উনি সব ব্যাপারেই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। জীবনে করবার মধ্যে একটা কাজ করেছিলেন, রিপন কলেজ থেকে আইনের ডিগ্রি নিয়ে বি সি এস পরীক্ষায় বসেছিলেন।”
দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির মনে আছে স্ত্রীর কথা শুনে প্রথমে তিনি মিটমিট করে হেসেছিলেন। তারপর বউমার সামনেই স্ত্রীকে জেরা করেছিলেন, “প্রতিভা, আর কোনো কাজের কাজ, করিনি?”
গৃহিণী সস্নেহে কিন্তু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, “পরীক্ষায় পাস-দেওয়া ছাড়া সারাজীবনে তুমি আর কিছুই করোনি।”