আজ তো সোমবার? সুতরাং বুলবুলেরই চা তৈরি করার কথা। কিন্তু চুড়ির আওয়াজ তো বুলবুলের নয়। বিছানায় শুয়ে শুয়েই, ব্যাপারটা বুঝতে পারলো সোমনাথ। ছোটদার শোবার ঘরের দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেলো এবার। সেই সঙ্গে বুলবুলের হাতের চুড়ির আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে।
বুলবুলের গলার স্বর একটু চড়া। এবার তার কথা শুনতে পাওয়া গেলো। “কি লজ্জার ব্যাপার বলুন তো? ঘুম থেকে উঠতে পনেরো মিনিট দেরি করে ফেললাম।”
কমলা বউদির কথাও সোমনাথের কানে আসছে। তিনি বুলবুলকে বললেন, “লজ্জা করে লাভ নেই। বাথরুমে গিয়ে চোখ-মুখ ধুয়ে এসো।”
স্বামীর প্রসঙ্গ তুলে বুলবুল বললো, “ও আমাকে ডেকে না দিলে এখনও ঘুম ভাঙতো না বোধহয়।”
“ঠাকুরপো তোমাকে তাহলে বেশ শাসনে রেখেছে! ভোরবেলায় একটু ঘুমোবার সুখও দিচ্ছে না!” কমলা বউদির রসিকতা সোমনাথের বিছানা থেকেই শোনা যাচ্ছে। ছোট দেওর যে এই সময় জেগে থাকতে পারে তা ওরা দুজনে আন্দাজ করতে পারেনি।
বুলবুলের বেশিদিন বিয়ে হয়নি। এ-বাড়ির কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে একটা স্বাভাবিক লজ্জাবোধ এখনও আছে। কমলাকে সে বললো, “ভাগ্যে আপনি উঠে পড়েছেন। না হলে কি বিশ্রী ব্যাপার হতো! চায়ের অপেক্ষায় বাবা বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকতেন।”
চায়ের কাপ সাজানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কমলা বউদি বললেন, “অনেকদিনের অভ্যেস তো—ঠিক পৌনে ছ’টায় ঘুম ভেঙে গেলো। ছ’টা দশেও যখন কেটলি চড়ানোর আওয়াজ পেলাম না, তখন বুঝলাম তুমি বিছানা ছাড়েনি।”
বুলবুল বললো, “ভোরের দিকে আমার কী যে হয়! যত রাজ্যের ঘুম ওই সময় আমাকে ছে’কে ধরে।”
কমলা বউদি অল্প কথার মানুষ কিন্তু রসিকতা বোধ আছে পুরোপুরি। বললেন, ঘুমের আর দোষ কি? রাত দুপুর পর্যন্ত বরের সঙ্গে প্রেমালাপ করবে, ঘুমকে কাছে আসতে দেবে না। তাই বেচারাকে শেষ রাতে সুযোগ নিতে হয়।”
কমলা বউদির কথা শুনে সোমনাথেরও হাসি আসছে। বুলবুলের সলজ্জ ভাবটা নিজের চোখে দেখতে ইচ্ছে করছে। হাজার হোক কলেজে একসময় বুলবুল ওর সহপাঠিনী ছিল। বুলবুল বলছে, “বিশ্বাস করুন, দিদিভাই, কাল সাড়ে-দশটার মধ্যে দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছি। এখন তো আর নবদম্পতি নই।”
কমলা বউদি ছাড়লেন না। “বলো কি? এখনও পুরো দ’বছর বিয়ে হয়নি, এরই মধ্যে বুড়ো-বুড়ি সাজতে চাও?”
“কী যে বলেন!” বুলবুল আরও কিছু মন্তব্য করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কথা আর শোনা গেলো না। সোমনাথের কাছে বুলবুল যতই স্মার্ট হোক, গুরুজনদের কাছে সে বেশ নার্ভাস।
কমলা বউদি বললেন, “এ-নিয়ে লজ্জা পাবার কিছু নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বরের সঙ্গে মনের সুখে গল্প করবে এটা তোমার জন্মগত অধিকার। তাছাড়া, ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলেও ঠাকুরপোর হয়তো তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। বরের রিলিজ অর্ডার না পেলে তুমি কী করবে?”
“দাদা নিশ্চয় আপনাকে সকালবেলায় ছাড়তে চান না।” বুলবুল এবার পাল্টা প্রশ্ন করলো।
কমলা বউদি উত্তর দিতে একটু দেরি করছেন। বোধহয় চায়ের কাপগুলো শুকনো কাপড় দিয়ে মুছছেন—কিংবা লজ্জা পেয়েছেন। না, কমলা বউদি সামলে নিয়েছেন। অল্পবয়সী জা-কে ভয় দেখালেন, “বম্বেতে আজই প্রশ্ন করে পাঠাচ্ছি। লিখবো তোমার ভাদ্দর বউ জানতে চাইছিল!”
সোমনাথের চোখে আবার ঘুম নেমে আসছে। বাইরের কথাবার্তায় সে আর মনোযোগ দিতে পারছে না। কিন্তু কমলা ও বুলবুল তাদের আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
দাদাকে চিঠি লেখার প্রসঙ্গে বুলবুল বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। সন্ত্রস্ত হরিণীর মতো মুখভঙ্গি করে বুলবুল বললো, “লক্ষ্মীটি দিদিভাই। দাদা এসব শুনলে, আমি ওঁর সামনে লজ্জায় যেতে পারবো না। আপনার কাছে মাপ চাইছি, কাল থেকে সময়মতো উঠবোই…”
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল বুলবুল। কিন্তু কমলা চাপা অথচ শান্ত গলায় জা-এর বক্তব্যের শূন্যস্থান পূরণ করলো, “তার জন্যে যদি রাত্রিবেলায় বরের সঙ্গে প্রেম বন্ধ রাখতে হয় তাও!”
এবার কেটলি নামিয়ে কমলা মেপে মেপে কয়েক চামচ চা চীনেমাটির পটে দিলো, আর একটা বাড়তি চামচ চা দিলো পটের জন্যে। কমলা তারপর বুলবুলকে বললো, “ছোটবেলা থেকে আমার সকালে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সুতরাং তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। সকালে বাবাকে আমিই চা করে দেবো।”
বুলবুলের মুখে কৃতজ্ঞতার রেখা ফুটে উঠেছিল। তবু সে আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল। কিন্তু কমলা বললো, “বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে জল দিয়ে এসো। ঘুম ভেঙে বউ-এর চোখে পিঁচুটি দেখলে বর মোটেই খুশী হবে না।”
বুলবুল বাথরুমে চলে গেলো। কমলা চটপট এক কাপ চায়ে দুধ মেশালে। তারপর মাথায় ঘোমটা টেনে, শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে নিয়ে, একটা প্লেটে দু’খানা নোনতা বিস্কুট বার করে শ্বশুরমশায়ের উদ্দেশ্যে দোতলায় চললো।
দোতলায় মাত্র একখানা ঘর। সেই ঘরে একমাত্র দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি থাকেন। ভোরবেলায় কখন যে তিনি ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন কেউ জানে না।
সকালবেলায় প্রাত্যহিক হাঙ্গামা সেরে দক্ষিণের ব্যালকনিতে দ্বৈপায়ন শান্তভাবে বসে রয়েছেন। বাড়ির পুব দিকটা এখনও খোলা আছে। সেদিক থেকে ভোরবেলায় মিষ্টি রোদ সলজ্জভাবে উঁকি মারছে। বাবা সেইদিকে চুপচাপ তাকিয়ে রয়েছেন। কমলার ধারণা, বাবা এই সময়ে মনে মনে ঈশ্বরের আরাধনা করেন।
চায়ের কাপ নামিয়ে সনম্র কমলা বাবাকে প্রণাম করলো। পায়ের ধূলো নিতে গেলে গোড়ার দিকে বাবা আপত্তি করতেন—এখন মেনে নিয়েছেন। বর্ধমাতাকে তিনি প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন।