আজও কয়েকটা অ্যাকনলেজমেন্ট ফর্ম ফিরেছে। সেই সঙ্গে সোমনাথের নামে একটা চিঠিও এসেছে। কয়েকদিন আগে বক্স নম্বরে একটা চাকরির বিজ্ঞাপনের উত্তর দিয়েছিল। তারাই উত্তর দিয়েছে। লিখেছে অবিলবে ওদের কলকাতা প্রতিনিধি মিস্টার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে। মিস্টার চৌধুরী মাত্র কয়েকদিন থাকবেন, সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করা উচিত।
ঠিকানা কীড্ স্ট্রীটের। সময় নষ্ট না করে সোমনাথ বেরিয়ে পড়লো। বউদি জিজ্ঞেস করলেন, “বেরচ্ছো নাকি?”
ফর্সা সাদা শার্ট প্যান্ট ও সেই সঙ্গে টাই দেখে কমলা বউদি আন্দাজ করলেন চাকরির খোঁজে বেরচ্ছে সোমনাথ।
মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেন, ওর একটা চাকরি করে দাও ঠাকুর। বিনা অপরাধে ছেলেটা বড় কষ্ট পাচ্ছে।”
কমলার মনে পড়লো, কী আমুদে ছিল সোমনাথ। সবসময় হৈ-চৈ করতো। বউদির পিছনেও লাগতো মাঝে মাঝে! বলতো, “বউদি আপনাকে একদিন আমাদের কলেজে নিয়ে যাবো। মেয়েগুলোকে দেখলে, মডার্ন স্টাইল কাকে বলে আপনার ধারণা হয়ে যাবে। অফিসারের বউ হয়েছেন, কিন্তু আপনার গেয়ো স্টাইল পাল্টাচ্ছে না।”
কমলা হেসে বলতো, “আমরা তো সেকেলে, ভাই। তোমার বিয়ের সময় বরং দেখেশনে আধুনিকা মেয়ে পছন্দ করে আনা যাবে।”
সোমনাথ বলতো, “সেসব দিনকাল পাল্টেছে। এখন সব মেয়ে নিজের পছন্দ মতো তো আগে থেকেই ঠিক করে রাখছে, কাকে বিয়ে করবে।”
কমলা বলতো, “আমরাও তো কলেজে পড়েছি। তখন তো এমন ছিল না।”
সোমনাথ বলতো, সেসব দিনকাল পাল্টেছে। এখন সব মেয়ে নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করতে চায়।”
কমলার জন্মদিনে সোমনাথ একবার কাগজের মুকুট তৈরি করেছিল। ঝলমলে রাঙতা, লাগানো মুকুট বউদিকে পরতে বাধ্য করেছিল সে—তারপর ছবি তুলেছিল।
কাজলের সঙ্গে বুলবুলের বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল যখন, তখন সোমনাথই গোপন তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল। সহপাঠিনী সম্বন্ধে সোমনাথ বলেছিল, “দীপান্বিতার বেজায় ডাঁট। ওর সঙ্গে মেজদার বিয়েটা লাগলে, বউদি বেশ হয়। ওর তেজ একেবারে মিইয়ে যাবে!”
সন্ধ্যের আগেই সোমনাথ ফিরে এলো। সে যখন শার্ট খুলেছে তখনই কমলা ওর ঘরে ঢুকলো। সোমনাথের মুখে যেন একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
কীড স্ট্রীটের মিস্টার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছে সোমনাথ। চাকরিটা সেলস লাইনের। কলকাতার বাইরে বাইরে ঘুরতে হবে। তাতে সোমনাথের মোটেই আপত্তি নেই। কিন্তু লোকটা কিছু টাকা চাইছে।
লোকটাকে অবিশ্বাস করতে পারতো সোমনাথ। কিন্তু খোদ এম-এল-এ গেস্ট হাউসে বসে ভদ্রলোক কথাবার্তা বললেন। সোমনাথের চোখে-মুখে দ্বিধার ভাব দেখে মিঃ চৌধুরী বললেন, “চারশ’ টাকা মাইনের চাকরির জন্যে আড়াইশ’ টাকা পেমেন্ট আজকালকার দিনে কিছু নয়। রেল, পোস্টাপিস, ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে চাকরি এখন নিলামে উঠছে। বহলোক ছ’মাসের মাইনে সেলামী, দিতে রাজী রয়েছে।”
সোমনাথের মনে যতটুকু সঙ্কোচ ছিল, কমলা তা কাটিয়ে দিলো। সে বললো, “বাবা শুনলে, হয়তো রেগে যাবেন। কড়া প্রিন্সিপিলের লোক—উনি এইসব ঘষঘাষে রাজী হবেন না। কাজলকেও অতশত বোঝাতে পারবো না। কিন্তু সামান্য কয়েকটা টাকার জন্যে সযোগটা ছেড়ে লাভ কী? আমার কাছে আড়াইশ’ টাকা আছে।”
সংসার-খরচের টাকা থেকে লুকিয়ে বউদি যে টাকাটা দিচ্ছেন সোমনাথ তা বুঝতে পারলো। আগামীকাল কীড্ স্ট্রীটের এম-এল-এ কোয়ার্টারের সামনে লোকটার সঙ্গে দেখা করবে সোমনাথ। ভদ্রলোক চব্বিশ ঘণ্টার সময় দিয়েছেন।
প্রবল উত্তেজনার মধ্যে সময় কাটছে। মিস্টার চৌধুরী বলছেন, “এখন আড়াইশ’ দিয়ে বিহারে পোস্টিং নিন, তারপর আরও আড়াইশ’ খরচ দেবেন, কলকাতায় ট্রান্সফার করিয়ে দেবো।”
ভোরবেলার দিকে চাকরি পাবার স্বপ্ন দেখলো সোমনাথ। আড়াইশ’ টাকা পকেটে পরে মিস্টার চৌধুরী একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। তাই নিয়ে বাড়িতে চা আনন্দের উত্তেজনা। বাবা মুখে কিছু না বললেও, বেশ জোর গলায় বড় বউদিকে আর এক কাপ চায়ের হুকুম দিচ্ছেন। সোমনাথকে সামনে বসিয়ে অফিসের পলিটিকস সম্বন্ধে সাবধান সকতে বলছেন। কী করে কম স্থানে সবার মনোহরণ করতে হয় সে সম্বন্ধে উপদেশ দিচ্ছেন।
ভূতপূর্ব কলেজবান্ধবী এবং বর্তমানে বউদি বুলবুলেরও খুব আনন্দ হয়েছে। বুলবুল বলছে, “কোনো কথা শুনছি না সোম—প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই সায়েবপাড়ায় একখানা ইংরেজী সিনেমা দেখাতে হবে এবং ফেরবার পথে পাক স্ট্রীটে গোল্ডেন ড্রাগনে চাইনিজ ডিনার।” সোমনাথ রাজী হয়েও রসিকতা করছে, “পয়সা সস্তা পেয়েছো? সিনেমা দেখাবো, কিন্তু নো চাইনিজ ডিনার।” বুলবুল রেগে গিয়ে বলছে, “আমাকে খাওয়াবে কেন? তার বদলে যাকে নিয়ে যাবে তার নাম আমি জানি না, এটা ভেবো না!”
চীনে রেস্তরাঁর দোতলায় নিয়ে যাবার সোমনাথের অন্য কেউ আছে এমন একটা সন্দেহ বুলবুল অনেকদিন থেকেই করছে। হাজার হোক কলেজে প্রতিদিন সোমনাথকে দেখেছে
সে। আর এসব ব্যাপারে মেয়েদের সন্ধানী চোখ ইলেকট্রনিক রাডারকে হারিয়ে দেয়।
সোমনাথের চাকরিতে সবচেয়ে খুশী হয়েছেন কমলা বউদি। বউদি কিন্তু কিছুই চাইছেন না। মাঝে মাঝে শুধু ছোট দেওরের পিঠে হাত দিয়ে বলছেন, “উঃ! যা ভাবনা হয়েছিল। আজই কালীঘাটে যেতে হবে আমাকে। কাউকে না বলে পঞ্চাশ টাকা মানত করে বসে আছি।” . বুলবুল বললো, “নো ভাবনা দিদি! ঐ পঞ্চাশ টাকাও সোমের প্রথম মাসের মাইনে থেকে ডেবিট হবে।”