বাবাকে আবার বোঝাবার চেষ্টা করলো কমলা। বললো, “আজকালকার ছেলেদের সম্বন্ধে যা শনি তার থেকে সোম অনেক ভালো। ওর মনটা এখনও সংসারের নোংরামিতে বিষিয়ে যায়নি বাবা।”
দ্বৈপায়ন বিশেষ ভিজলেন না। বললেন, “তোমার কাছে বলতে বাধা নেই, এক-এক সময় মনে হয় কাউকে বেশি প্রোটেকশন দিতে নেই। বেশি সুখ, বেশি স্বাচ্ছন্দ্য, বেশি নিশ্চয়তার মধ্যে থাকলে অনেক সময় মানুষের ভিতরের আগনটা জ্বলে ওঠবার সুযোগ পায় না। যাদের দেখবে প্রচণ্ড অভাব, প্রচণ্ড অপমান, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যাদের কোনো ভরসা। নেই—তারা অনেক সময় নিজেদের দুঃখের শিকল নিজেরাই ছিঁড়ে ফেলে। তারা অপরের মুখ চেয়ে বসে থাকে না।”
কমলা বুঝতে পারলো বাবা কী বলতে চাইছেন। কিন্তু সব সময় কথাটা সত্যি নয়। সুকুমারকে তো বাবা চেনেন, তাহলে সে তো এতোদিন আশ্চর্য কিছু একটা করে ফেলতো।
কমলা এবার একতলায় নেমে এলো। তার ভয়, সোমনাথ এসব না জেনে ফেলে। রাগের মাথায় বাবা কোনোদিন না সোমনাথের সঙ্গেই এসব আলোচনা করে বসেন। বাইরের সমস্ত দুনিয়া তো বেচারাকে অপমান করছে, এর পর বাড়ির আত্মসম্মানটুকু গেলে ছেলেটা কোথায় দাঁড়াবে?
দ্বৈপায়নও একটু লজ্জা পেলেন। সত্যি, এই সব ছেলে যে এখনও সভ্যভব্য রয়েছে, এটা কম কথা নয়। সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে ঘরে ঘরে লক্ষ লক্ষ ছেলে যদি উচ্ছন্নে চলে যায়, তাহলে সেও এক ভয়াবহ ব্যাপার হবে। সত্যিই তো সোমনাথের বিরদ্ধে বেকারত্ব ছাড়া তাঁর আর কোনো অভিযোগ নেই। একটা চাকরি সে যোগাড় করতে পারেনি। কিন্তু আর কোনো কষ্ট সোমনাথ তো বাবাকে দেয়নি। আজকাল ছেলেপলে সম্বন্ধে যেসব কথা কানে আসে, তারা যেসব কাণ্ড বাধিয়ে বসেছে, তাতে বাপ-মায়ের পাগল হয়ে যাওয়া ছাড়া, উপায় নেই।
গতকালই তো দ্বৈপায়ন শুনলেন, অনেক বেকার ছেলে বাড়িতে, আজকাল চরম দুর্ব্যবহার করছে। তারা বাড়ির সব সুবিধে নিচ্ছে, অথচ চোখও রাঙাচ্ছে। তারা নিজেদের জামাকাপড় পর্যন্ত কাচে না, একগ্লাস জল পর্যন্ত গড়িয়ে খায় না, বাড়ির কোনো কাজ করে না এবং বাড়ির কোনো আইন মানতেও তারা প্রস্তুত নয়। বাড়িটাকেও ওরা জঙ্গল করে তুলছে।
দ্বৈপায়ন ভাবলেন, এই সব ছেলে বাইরে হেরে গিয়ে, বাড়ির ভিতরে এসে যেন-তেনউপায়ে জিততে চায়। এরা প্রত্যেকে এক-একটা সাইকলজিক কেস। গতকালই তো নগেনবাবরে কথা শুনলেন। ওঁর বড় ছেলেটা মস্তান হয়েছে। সকাল সাড়ে-ন’টার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। জলখাবার খেয়ে বাড়ি থেকে কেটে পড়ে। ভাত খাবার জন্যে ফিরে আসে তিনটের সময়। আবার বেরিয়ে পড়ে। ফেরে রাত এগারোটায়। বিড়ি সিগারেট টানে। রাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করেছে। নগেনবাব খুব বকুনি লাগিয়ে বলেছিলেন, “তোমাকে ছেলে বলে পরিচয় দিতে আমার লজ্জা হয়।” ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, “দেবেন না।” চরম দুঃখে নগেনবাব বলেছিলেন, “এই জনেই বুঝি লোকে সন্তান কামনা করে?” ছোকরা এতোখানি বেয়াদপ, বাবার মুখের ওপর বলেছে, “ছেলের জন্ম হওয়ার পিছনে আপনার অন্য কামনাও ছিল, সন্তান একটা বাই-প্রোডাক্ট মাত্র।
ছেলের কথা শুনে নগেনবাব শয্যাশায়ী হয়েছিলেন দু’দিন। এখনও লকিয়ে-লুকিয়ে চোখের জল ফেলেন।
বউমাকে বলে দিলে হতো, খোকন যেন এদের কথাবার্তার কিছু জানতে না পারে। তারপর দ্বৈপায়ন ভাবলেন, বউমা বুদ্ধিমতী, ওকে সাবধান করবার প্রয়োজন নেই।
০৬. দুপরের ক্লান্ত ঘড়িটা
দুপরের ক্লান্ত ঘড়িটা যে সাড়ে-তিনটের ঘরে ঢুকে পড়েছে তা সোমনাথ এবার বুঝতে পারলো। কমলা বউদি ঠিক এই সময় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো এই সময় কমলা বউদি বাড়ির লেটার বাক্সটা দেখেন। পিওন আসে তিনটে নাগাদ এবং তারপর থেকেই বাবা ছটফট করেন। মাঝে-মাঝে জিজ্ঞেস করেন, “চিঠিপত্তর কিছু এলো নাকি?” বাবার নামে প্রায় প্রতিদিনই কিছু, চিঠিপত্তর আসে। চিঠি লেখাটা বাবার নেশা। দনিয়ার যেখানে যত আত্মীয়স্বজন আছেন বাবা নিয়মিত তাঁদের পোস্টকার্ড লেখেন। তার ওপর আছেন অফিসের পুরানো সহকমীরা। রিটায়ার করবার পরে তাঁরাও দ্বৈপায়নের খোঁজখবর নেন।
সোমনাথেরও চিঠি পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিদেশী এক এমব্যাসির বিনামূল্যে পাঠানো একখানা সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাড়া তার নামে কিছুই আসে না। এই পত্রিকা পাবার বুদ্ধিটাও সুকুমারের। দুখানা পোস্টকার্ডে দুজনের নামে চিঠি লিখে দিয়েছিল দিল্লীতে এমব্যানির ঠিকানায়। বলেছিল, “পড়িস না পড়িস কাগজটা আসুক। প্রত্যেক সপ্তাহে পত্রিকা এলে পিওনের কাছে সুকুমার মিত্তির নামটা চেনা হয়ে যাবে। আসল চাকরির চিঠি যখন আসবে তখন ভুল ডেলিভারি হবে না।”
এই সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাড়া গত সপ্তাহে সোমনাথের নামে একটা চিঠি এসেছিল। বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানির বিশেষ যন্ত্রে প্রতিদিন পাঁচ মিনিট দৈহিক কসরত করলে টারজনের মতো পেশীবহুল চেহারা হবে। ডাকযোগে মাত্র আশি টাকা দাম। বিফলে মূল্য ফেরত। বিজ্ঞাপনের চিঠি পেয়ে প্রথমে বিরক্তি লেগেছিল। তারপর সোমনাথের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো। বম্বের কোম্পানি কষ্ট করে নাম-ঠিকানা জেনে চিঠি পাঠিয়ে তাকে তো কিছু, সম্মান দিয়েছে। চাকরিতে ঢুকলে, সোমনাথ ওই যন্তর একটা কিনে ফেলবে—পয়সা জলে গেলেও সে দুঃখ পাবে না।
এ-ছাড়া সোমনাথের পাঠানো রেজিস্টার্ড অ্যাকনলেজমেন্ট ডিউ ফর্মগুলো দু-তিনদিন অতর ফিরে আসে। নিজের হাতে লেখা নিজের নাম সোমনাথ খুঁটিয়ে দেখে। তলায় একটা রবার-স্ট্যাম্পে কোম্পানির ছাপ থাকে—তার ওপর একটা দুর্বোধ্য হিজিবিজি পাকানো রিসিভিং ক্লার্কের সই।