এই ধরনের কথাবার্তা বাবার সঙ্গে এ-বাড়ির কেউ বলতে সাহস করবে না।
বাবা যে আবার সোমনাথ সম্পর্কে চিন্তা আরম্ভ করেছেন তা কমলা ওঁর মুখের ভাব দেখেই বুঝলো।
দ্বৈপায়ন জিজ্ঞেস করলেন, “খোকন কোথায়?”
সোমনাথ এখনও ফেরেনি শুনে প্রথমে একটু বিরক্তি এলো দ্বৈপায়নের। ভাবলেন, কোনো দায়িত্বজ্ঞান নেই বেশ টো-টো করে ঘুরছে। তারপর নিজেকে সামলে নিলেন। ঘোরা ছাড়া ওর কী-ই বা করবার আছে?
ঠিক সময়ে সোমনাথ বাড়ি ফিরলে দ্বৈপায়ন তবু একটু নিশ্চিন্ত হতে পারেন। অজিকাল যেরকম খুনোখুনীর যুগ পড়েছে, তাতে মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা হয় দ্বৈপায়নের। কয়েকবছর আগে সমর্থ মেয়েদেরই একলা বাইরে বেরতে দিতে ভয় করতে বাবা-মায়েরা। এখন জোয়ান ছেলেদের নিয়ে বেশি চিন্তা। গোপনে গোপনে এদের মনের মধ্যে কখন কীসের চিন্তা আসবে কে জানে। তারপর রাজনীতির নেশায় দলে পড়ে, সমাজের ওপর বিরক্ত হয়ে, কী করে বসবে কে জানে? দ্বৈপায়ন ভাবলেন, আত্মহনন ছাড়া এযুগের অভিমানী ছেলেগুলো অন্য কিছুই জানে না।
কমলা এবার বশরের চিতা নিরসন করলো। বললো, “সোমের বধূ অরবিন্দর বৌভাত আজ। যেতে চাইছিল না। আমি জোর করে পাঠিয়েছি।”
“অরবিন্দ তাহলে কাজ পেয়েছে। পড়াশুনোয় ও তো খুব ভালো ছিল না।” দ্বৈপায়ন নিজের মনেই বললেন।
“ওর বাবা চেষ্টা করে কোনো বড় অফিসে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, সোম বলছিল।” ও দ্বৈপায়ন বউমার এই কথা শুনে অস্বস্তি বোধ করলেন। নিজের অক্ষমতাকে চাপা দেবার জন্যেই যেন সমস্ত দোষ সোমের ওপর চাপাবার চেষ্টা করলেন। বেশ বিরক্তির সঙ্গে বউমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন এমন হলো বলো তো?”
কমলা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো।
দ্বৈপায়ন বললেন, “আমি তো কখনও পরীক্ষায় খারাপ করিনি। নিজের চেষ্টায় কম্পিটিশনে স্ট্যান্ড করে সরকারী কাজে ঢুকেছিলাম। ওর দাদাদের জন্যে কোনোদিন তো মাস্টার পর্যন্ত রাখিনি। তারা অত ভালো করলো। অথচ খোকন কেন যে অত অর্ডিনারি হলো?”
কমলা বশরের সঙ্গে একমত হতে পারছে না। সোম মোটেই অর্ডিনারি নয়। ওর বেশ বুদ্ধি আছে। কমলা বললো, “পরীক্ষাটা আজকাল পুরোপুরি লটারি, বাবা। সোমনাথ তো বেশ বুদ্ধিমান ছেলে।”
দ্বৈপায়ন ঠোঁট উল্টোলেন। “তুমি বলতে চাও, ওর ওপর এগজামিনারের রাগ ছিল?”
“তা হয়তো নয়। কিন্তু আজকাল কীভাবে যে পরীক্ষা-টরিক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষকরাও বোঝেন না যে এর ওপর ছেলেমেয়েদের জীবন নির্ভর করছে।
“এর মধ্যেই অনেকে ভালো রেজাল্ট করছে, বউমা।” দ্বৈপায়নের গলার স্বরে ছোট ছেলে সম্পর্কে ব্যঙ্গ ফুটে উঠলো।
ছোট দেওর সম্পর্কে কমলার একটু দুর্বলতা আছে। বিয়ের পর থেকে এতোদিন ধরে ছেলেটাকে দেখছে কমলা। দুজনে খুব কাছাকাছি এসেছে।
“ওর মনটা খুব ভালো বাবা,” কমলা শান্তভাবে বললো।
“মন নিয়ে এ-সংসারে কেউ ধয়ে খাবে না, বউমা,” বিরক্ত দ্বৈপায়ন উত্তর দিলেন। “পড়াশোনায় ভালো না করলে, দুনিয়াতে কোনো দাম নেই।”
“পড়াশোনায় ভালো অথচ স্বভাবে পাজী এমন ছেলে আজকাল অনেক হচ্ছে, বাবা। তাদের আমার ভালো লাগে না,” কমলা বললো। তার ঘোমটা খসে পড়েছিল, সেটা আবার মাথার ওপর তুলে নিলো।
“যে-গোরু দুধ দেয় তার লাথি অনেকে সহ্য করতে রাজী থাকে বউমা,” দ্বৈপায়ন বিরক্তভাবেই উত্তর দিলেন।
“খোকন তো চেষ্টা করছে বাবা,” কমলা ব্যর্থ চেষ্টা করলো শ্বশুরকে বোঝাবার।
“চেষ্টা নিয়ে সংসারে কী হবে? রেজাল্ট কী, তাই দিয়েই মানুষের বিচার হবে,” দ্বৈপায়ন যে সোমনাথের ওপর বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছেন তা তাঁর কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু কমলা কী করে সোমনাথের বিরদ্ধে মতামত দেয়? সোমনাথ তো কখনও বড়দের অবাধ্য হয়নি। বাড়ির সব আইনকানন খোকন মেনে চলেছে। পড়ার সময় পড়তে বসেছে। অন্য কোনো দুষ্টমির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েনি। গোড়ার দিকে সে তো পড়াশোনায় খারাপ ছিল না কিন্তু মা দেহ রাখার পর কী যে হলো। ক্রমশ সোমনাথ পিছিয়ে পড়তে লাগলো। সেকেন্ড ডিভিসনে স্কুল ফাইনাল পাস করলো। বাবার ইচ্ছে ছিল এক ছেলে ইনজিনীয়ার, এক ছেলে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট এবং ছোট ছেলেকে ডাক্তার করবেন। কিন্তু ভালো নম্বর না থাকলে ডাক্তারিতে ঢোকা যায় না।
কমলার মনে পড়লো, সোমনাথ একবার বউদিকে বলেছিল, “আমাকে অত ভালোবাসবেন না বউদি। আপনার বিশ্বাসের দাম তো আমি দিতে পারবো না। আমি সব বিষয়ে অর্ডিনারি।”
কমলা বলেছিল, “তোমাকে আর পাকামো করতে হবে না।”
সোমনাথ বলেছিল, “মায়ের রং কত ফর্সা ছিল আপনি তো দেখেছেন। দাদারা ফর্সা। হয়েছে। আমার রং দেখুন কালো। ভাগ্যে মেয়ে হইনি, তাহলে বাবাকে এই বাড়ি বিক্রি করতে হতো। পড়াশোনায় কখনও ফাঁকি দিইনি—কিন্তু অর্ডিনারি থেকে গেছি। অনেকে গান-বাজনা কিংবা খেলাধুলোয় ভালো হয়। আমার তাও হলো না।
দুনিয়ার সব মানুষকে ব্রিলিয়ান্ট হতে হবে, এ কী রকম কথা? পৃথিবীর কেন, দেশে ক’টা লোক ব্রিলিয়ান্ট হয়? বেশির ভাগ মানুষই তো অতি সাধারণ। কিন্তু তারা কেমন সখে স্বাচ্ছন্দ্যে রয়েছে। কমলা বুঝতে পারে না, এই দেশের কী হতে চলেছে। ব্রিলিয়ান্ট হোক না-হোক সোমকে খুব ভালো লাগে কমলার। ছেলেটা খুব নরম। ওর মনে নোংরামি নেই। অনেক বাড়িতে এক ভাই আরেক ভাইকে হিংসা করে। সোমের শরীরে হিংসে নেই। আর বউদিকে সে যে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে তা কমলা ভালোভাবে জানে।