“দুই ভাই যদি গণের হয়? তবু তারা এক অফিসে জায়গা পাবে না?” কমলা বড় সায়েবের সঙ্গে ঠিক একমত হতে পারলো না।
দ্বৈপায়ন বললেন, “তা হলেও নয়। সায়েবদের ধারণা, একই পরিবারের বেশি লোক একই অফিসে ঢুকলে নানা সমস্যা দেখা দেয়।”
কমলার তবু ভালো লাগছে না। সে বললো, “একই পরিবারের লোক এক অফিসে থাকলে বরং সুবিধে। এ ওকে দেখবে।”
হাসলেন দ্বৈপায়ন। বললেন, “বউমা, কর্মস্থল এবং ফ্যামিলি এক নয়, তুমি ভোম্বলকে জিজ্ঞেস করে দেখো।”
কমলা কিছুতেই একমত হতে পারছে না। সে বললো, “কেন বাবা? ওঁদের অফিস থেকে যে হাউস-ম্যাগাজিন আসে তাতে যে প্রত্যেক সংখ্যায় লেখা হয়, কোম্পানিও একটা পরিবার। প্রত্যেকটি কর্মচারি এই পরিবারের লোক।”
হাসলেন দ্বৈপায়ন। “ওটা সত্যি কথা নয়, বউমা। নামকাওয়াস্তে বলতে হয়, তাই বড়-কর্তারা বলেন। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেন না। ভোম্বল একটা বই এনে দিয়েছিল, তাতে পড়েছিলাম—অফিসটা হলো পরিবারের উল্টো। অফিসে আদর্শের কোনো দাম নেই– সেখানে যে ভালো কাজ করে, যে বেশি লাভ দেখাতে পারে তারই খাতির। সে লোকটা মানুষ হিসেবে কেমন তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। অথচ ফ্যামিলিতে মনুষ্যত্বের দামটাই বেশি দেবার চেষ্টা করি আমরা। দয়া মায়া স্নেহ মমতা এসবের কোনো স্বীকৃতি নেই অফিসে। যে ভুল করে, দোষ করে, নিয়ম ভাঙে, ঠিক মতো প্রোডাকশন দেয় না, কর্মক্ষেত্রে তাকে নির্দয়ভাবে শাসন করতে হয়—সংসারে কিন্তু তা হয় না। অফিসে যে ভালো কাজ করে তার দাম। বাড়িতে কোনো ছেলে পরীক্ষায় ফেল করলেও তার ওপর ভালোবাসা কমে যায় না। বরং অনেক সময় ভালোবাসা বাড়ে।”
কমলা এতো বুঝতো না। সে সবিস্ময়ে সরল মনে বললো, “তাহলে পরিবারটাই তো অনেক ভালো জায়গা, বাবা।”
দ্বৈপায়ন হাসলেন। “সে-কথা বলে। সংসারটাই তো আমাদের আশ্রয়-সংসারের ভালোর জন্যেই তো লোকে আপিসে যায়।”
কমলা বললো, “আপিসে তো যাইনি, তাই ব্যাপারটা কখনও বুঝিনি, বাবা।”
“অনেকে সারাজন্ম আপিস গিয়েও ব্যাপারটা বোঝে না, মা। সংসারের মূল্যও তারা জানে না।”
কমলা তার পক্ষের মতো চোখ দুটো বড় বড় করে বিস্ময়ে বশরের দিকে তাকিয়ে থাকে। দ্বৈপায়ন বললেন, “ভোম্বলকে বোলো তো বইটা আবার নিয়ে আসতে। আর একবার উল্টে দেখবো, তুমিও পড়ে নিও। একটা কথা আমার খুব ভালো লেগেছিল—আমাদের এই সমাজটাও এক ধরনের অরণ্য। ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে তৈরি এই অরণ্যে জঙ্গলের নিয়মই চালু রয়েছে। এরই মধ্যে পরিবারটা হলো ছোট্ট নিরাপদ কুড়েঘরের মতো। এখান থেকে। বেরোলেই সাবধান হতে হবে; সবসময় মনে রাখতে হবে আমরা মানুষের জঙ্গলে বিচরণ। করছি।”
হতাশ হয়ে পড়লো কমলা। “তাহলে বলছেন, ভাইদের অফিসে সোমের কোনো আশা নেই?”
দুঃখের সঙ্গেই দ্বৈপায়ন স্বীকার করলেন, “কোনো সম্ভাবনাই নেই। এবং চেষ্টা করাও ঠিক হবে না, কারণ তাতে দুই দাদার কাজৈর ক্ষতি হতে পারে।”
দ্বৈপায়ন এবার বাথরুমে গা মুছবার জন্যে ঢাকলেন। কমলা সেই ফাঁকে দ্রুত এক গ্লাস হরলিকস তৈরি করে নিয়ে এলো।
ঠাণ্ডা জলের সংস্পর্শে এসে দ্বৈপায়ন এবার বেশ তাজা অনুভব করছেন। শরীরের অবসাদ নষ্ট হয়েছে।
কমল উঠতে যাচ্ছিল। দ্বৈপায়ন বললেন, “রান্না তো শেষ হয়ে গিয়েছে?”
“খাবার লোক তো এবেলায় কম। নগেনদি কেবল রুটিগুলো সেকছেন,” কমলা জানালো। দ্বৈপায়নের ইচ্ছে বউমা আরও একটু বসে যায়। বললেন, “তোমার যদি অসুবিধে না হয়, তাহলে আরও একটু বসো না, বউমা।”
বাবার মন বোঝে কমলা। বউমার সঙ্গেই একমাত্র তিনি সহজ হতে পারেন। আর সবার সঙ্গে কথা বলার সময় কেমন যেন একটা দুরত্ব এসে যায়। এই দূরত্ব কীভাবে গড়ে উঠেছে কেউ জানে না। ছেলেরা কাছে এসে তাঁর কথা শুনে যায়, কিছু, খবর দেবার থাকলে দেয়, কিন্তু সহজ পরিবেশটা গড়ে ওঠে না। কমলা বাবাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, কিন্তু প্রয়োজন হলে প্রশ্ন তোলে। আর বাবারও যে বউমার ওপর বেশ দুর্বলতা আছে তা সহজেই বুঝতে পারা যায়! বউমা প্রশ্ন করলে রাগ তো দুরের কথা তিনি খুশী হন। ছেলেদের অত সাহস নেই। তারা প্রতিবাদও করে না, প্রশ্নও করে না। তবে তারা বাবার অবাধ্য হয় না।
কমলা বললো, “বাবা, আপনি দুবেলা বেড়াতে বেরোবেন।”
“বেশ তো আছি, বউমা। এখানে বসে বসেই তো পৃথিবীর অনেকটা দেখতে পাচ্ছি।” দ্বৈপায়ন সস্নেহে উত্তর দেন। তারপর একটু থেমে বললেন, “আজকাল আর হাঁটতে ভালো লাগছে না। বয়স তো হচ্ছে।”
“আপনার কিছুই বয়স হয়নি,” মৃদ, বকুনি লাগালো কমলা। “আপনার বন্ধ, দেবপ্রিয়বাবু তো আপনার থেকে ছ’মাস আগে রিটায়ার করেছেন। সকাল থেকে টো-টো করছেন, তাস খেলছেন।”
“দেবটা চিরকালই একটু ফচকে। তাসের নেশা অনেকদিনের। আমার আবার তাসটা মোটেই ভালো লাগে না,” দ্বৈপায়ন বললেন।
ছোট মেয়ের মতো উৎসাহে কমলা বললো, “কাকীমা ‘সেদিন দেবপ্রিয়বাবকে খুব বকছিলেন। কাকাবাবু নাকি কোনো সিনেমা বাদ দেন না। আজকাল ম্যাটিনী শোতে হিন্দী বই পর্যন্ত লাইন দিয়ে দেখে আসেন একা-একা।”
গভীর দ্বৈপায়ন এবার হাসি চাপতে পারলেন না। বললেন, “দেব, তাহলে বুড়ো বয়সে হিন্দী ছবির খপ্পরে পড়লো। বউকে নিয়ে গেলেই পারে—তাহলে বাড়িতে আর অশান্তি হয় না।”
“দোষটা তো কাকাবাবুর নয়,” কমলা জানায়। “কাকীমা যে ঠাকুর-দেবতার বই ছাড়া দেখতে যাবেন না।”