টেরিটি বাজারের কাছে সোমনাথ ব্যানার্জি কী জন্যে দাঁড়িয়ে আছে? সে কোথায় যাবে? কেন? এই মুহূর্তে কোনো পরিচিত জন এইসব প্রশ্ন করলে সোমনাথ বেশ বিব্রত হয়ে পড়বে। অন্য যে-কোনোদিন হলে, মিথ্যা কিছু বলে দেওয়া যেতো। কিন্তু সোমনাথের পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়—আজ ১লা আষাঢ়। আষাঢ়ের এই প্রথম দিবসকে কবেকার কোন কবি নির্বাসিত এক যক্ষের বিরহবেদনায় স্মরণীয় করে তুলেছে। ২রা, ৩রা, ৫ই, ১৩ই, ১৫ই—আষাঢ়ের যে-কোনোদিনই তো মহাকবি কালিদাস বিরহী মর্মব্যথা উদ্ঘাটন করতে পারতেন—তাহলে এই ১লা তারিখটা সোমনাথ একান্তভাবে নিজের কাছে পেতো।
১লা আষাঢ় সোমনাথের জন্মদিন। চব্বিশ বছর আগে এমনই একদিনে সোমনাথ যে-হাসপাতালে ভূমিঠ হয়েছিল তার নাম সিলভার জুবিলী মাতৃসদন। পঞ্চম জর্জের রাজত্বের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে মহামান্য সম্রাটের অনুগত ভারতীয় প্রজাবৃন্দ নিজেদের উৎসাহে চাঁদা তুলে সেই হাসপাতাল তৈরি করেছিল। সিলভার জুবিলী হাসপাতালের বেবির নিজেরই সিলভার জুবিলী হতে চললো—সোমনাথ মনে মনে হাসলো।
চিৎপুর রোডের চলমান জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে সোমনাথের। মা বলতেন, জন্মদিনে ভালো হবার চেষ্টা করতে হয়। কাউকে হিংসে করতে নেই, কারুর ক্ষতি করতে নেই এবং মিথ্যে কথা বলা বারণ। ১লা আষাঢ়ের এই জটিল অপরাহ্নে রবীন্দ্র সরণিতে দাঁড়িয়ে সোমনাথ তাই মিথ্যে কথা বলতে পারবে না। কেউ প্রশ্ন করলে সোমনাথকে স্বীকার করতেই হবে, সে চলেছে মেয়েমানুষের সন্ধানে।
চমকে উঠছেন? বিব্রত বোধ করছেন? ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না? ভাবছেন, শুনতে ভুল করলেন? না, ঠিক শুনেছেন? ভদ্র, সভ্য, সুশিক্ষিত তরুণ সোমনাথ ব্যানার্জি চলেছে মেয়েমানুষের সন্ধানে এই শহরে যাদের কেউ বলে বেশ্যা, কেউ-বা কলগার্ল।
সোমনাথের বাবার নাম কয়েক বছর আগে একবার খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। কাগজের কাটিংটা সোমনাথ নিজেই কেটে রেখেছিল, তারপর কমলা বউদি পারিবারিক অ্যালবামে আঠা দিয়ে এঁটে রেখেছেন। দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি নিঃস্বার্থ দেশসেবার জন্যে সরকারী প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। সেই অবসরপ্রাপ্ত সরকারী গেজেটেড অফিসার দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির ছেলে সোমনাথ ব্যানার্জি রাস্তায় অপেক্ষা করছে—এখনই সে নারীর সন্ধানে বেরুবে।
কালের অবহেলায় মলিন রবীন্দ্র সরণির দিকে আবার তাকালো সোমনাথ। এই গলিত-নখদন্ত জরদগব চিৎপুর রোডকে নামান্তরিত করে চিরসন্দরের কবির নামের সঙ্গে জড়িয়ে দেবার কুৎসিত বুদ্ধিটা কার মাথায় এলো? কলকাতার নাগরিকরাও কেমন? কেউ কোনো প্রতিবাদ করলো না? বড়বাজারের আবর্জনায় মহাত্মা গান্ধীকে এবং চিৎপুরের পূতিগন্ধময় অন্ধকূপে রবীন্দ্রনাথকে নির্বাসিত করেও এরা কেমন আত্মতুষ্টি অনুভব করছেন।
উত্তেজনায় সোমনাথের দুটো কান ঈষৎ গরম হয়ে উঠছে। মিস্টার নটবর মিত্র এখনই এসে পড়বেন। মেয়েমানুষের ব্যাপারে নটবর মিত্র অনেক খবরাখবর রাখেন। কিন্তু কোথায় নটবর? তিনি কেন এতো দেরি করছেন?
বিব্রত সোমনাথ মুখ তুলে একবার আকাশের দিকে তাকালো। কোথাও এক টুকরো মেঘের ইঙ্গিত নেই। যদি আকাশে অনেক কালো মেঘ থাকতো; যদি বলা যেতে ‘আসন্ন আষাঢ় ঐ ঘনায় গগনে’—তাহলে বেশ হতো। বাধবন্ধনহীন বর্ষার প্রবল ধারায় সোমনাথ যদি নিজের অতীতকে সম্পর্ণ মুছে ফেলতে পারতো তাহলে মন্দ হতো না।
কিন্তু অতীতকে ভোলা তো দূরের কথা, সোমনাথের অনেক কিছু, মনে আসছে। অতীত ও বর্তমান মিলেমিশে একাকার হয়ে সোমনাথের মানস-আকাশকে বর্ষার মেঘের মতো ছেয়ে ফেলেছে। সোমনাথ পথেই দাঁড়িয়ে থাকুক। চলুন আমরা ততক্ষণ ওর অতীত সম্পর্কে খোঁজখবর করি—ওর পারিবারিক জীবনের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় হোক আমাদের।
০২. যোধপর পার্কে জলের ট্যাঙ্কের কাছে
যোধপর পার্কে জলের ট্যাঙ্কের কাছে লাল রংয়ের ছোট্ট দোতলা বাড়িটার একতলার ঘরে ভোরবেলায় সোমনাথ যখন বিছানায় শুয়ে আছে তখনই ওকে ধরা যাক।
একটু আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু নীল স্ট্রাইপ দেওয়া পাজামা আর হাতকাটা জালি গেঞ্জি পরে সোমনাথ এখনও পাশবালিশ জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছে।
সোমনাথের ঘরের বাইরেই এ-বাড়ির খাবার জায়গা। সেখানে চা তৈরির ব্যবস্থাও আছে। ওইখান থেকে চুড়ির ঠং ঠং আওয়াজ ভেসে আসছে। এই আওয়াজ শুনেই সোমনাথ বলে দিতে পারে, বড় বউদি অন্তত আধঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠে পড়ে সংসারের কাজকর্ম শুরু করেছেন। কমলা বউদি এই সময় মিলের আটপৌরে শাড়ি পরেন, তাঁর পায়ে থাকে বাটা কোম্পানির লাল রংয়ের শ্লিপার। চায়ের কাপ নামানোর আওয়াজ ভেসে আসছে—সুতরাং লিকুইড পেট্রলিয়াম গ্যাসের উননে বউদি নিশ্চয় চায়ের কেটলি চাপিয়ে দিয়েছেন।
ভোরবেলায় এই বাড়ির চা দু’বউ-এর একজনকে তৈরি করতে হবে। কারণ, দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি দিনের প্রথম চায়ের কাপটা ঝি-চাকরের হাত থেকে তুলে নেওয়াটা পছন্দ করেন না।
এ-বাড়ির অপর বউ দীপান্বিতা ওরফে বুলবুলের ওপরও মাঝে মাঝে চা তৈরির দায়িত্ব পড়ে। সোমনাথের ছোটদা একদিন বড় বউদিকে বলেছিল, তুমি রোজ-রোজ কেন ভোরবেলায় উঠবে? বুলবুলও মাঝে মাঝে কষ্ট করুক।
কমলা বউদি আপত্তি করেননি, কিন্তু মুখ টিপে হেসেছিলেন। হাসবার কারণটা সোমনাথের অজানা নয়। ছোটদার বউ বুলবুল বেজায় ঘুমকাতুরে। ঘড়ির মান-সম্মান বাঁচিয়ে ভোরবেলায় বিছানা থেকে উঠে চা তৈরি করা ওর পক্ষে বেশ শক্ত ব্যাপার।