‘তাহলে ওদের টনক নড়েছে। দেশের অবস্থা কোনদিকে চলছে ওরা বুঝতে পেরে ছোটাছুটি করছে,” সোমনাথ খবরটা পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলো।
“দূর, দেশের জন্যে তো ওদের ঘুম হচ্ছে না। ওরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। এক লাখ অ্যাপ্লিকেশন ইতিমধ্যে এসে গেছে শুনে সি-এ বললেন, কীভাবে এর থেকে সিলেকশন করবেন?
“অফিসার বললেন, সিলেকশন তো পরের কথা। তার আগে আমি কী করবো তাই বলুন? প্রত্যেক অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে তিন টাকার ক্রসড্ পোস্টাল অর্ডার এসেছে। তিন টাকার পোস্টাল অর্ডার হয় না, তাই মিনিমাম এক টাকার তিনখানা অর্ডার প্রত্যেক চিঠির সঙ্গে এসেছে। তার মানে এক লাখ ইনট, থ্রি অর্থাৎ তিন লাখ ক্রসড্ অর্ডারের পিছনে আমাকে সই করতে হবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জমা দেবার আগে। সব কাজ বন্ধ করে, দিনে পাঁচশোখানা সই করলেও আমার আড়াই বছর সময় লেগে যাবে। অথচ ফাইনানসিয়াল ব্যাপার, সই না করলেও অডিট অবজেকশনে চাকরি যাবে।”
হা-হা করে হেসে উঠলো সুকুমার। বললো, “লোকটার মাইরি, পাগল হবার অবস্থা। বলছে, হোল লাইফে কখনও এমন বিপদে পড়েনি।
কোন ডিপার্টমেন্ট রে?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো। তারপর উত্তরটা শুনেই ওর মুখ কালো হয়ে গেলো। ওই পোস্টের জন্যেই আরো তিন টাকার পোস্টাল অর্ডার কিনতে যাচ্ছে সে।
সুকুমার বললো, “তোর তিনটে টাকা জোর বেঁচে গেলো। ওই টাকায় ফুটবল খেলা দেখে, বাদাম ভাজা খেয়ে আনন্দ করে নে।”
খেলার মাঠের নেশাটা সোমনাথের অনেকদিনের। সুকুমারও ফুটবল পাগল। দুজনে অনেকবার একসঙ্গে মাঠে এসেছে। সোমনাথ বললো, “চল মাঠেই যাওয়া যাক। সুকুমারের আত্মসম্মান জ্ঞান টনটনে। সে কিছুতেই সোমনাথের পয়সায় মাঠে যেতে রাজী হলো না।
সোমনাথের হঠাৎ অরবিন্দের কথা মনে পড়ে গেলো। সুকুমারকে বললো, “শুনেছিস, রত্নার সঙ্গে অরবিন্দের বিয়ে। বাড়িতে একটা কার্ড রেখে গেছে।”
সুকুমার বললো, “আমাকেও একটা কার্ড পাঠিয়েছে ডাকে। শুভবিবাহ মাক কার্ড দেখে বাড়িতে আবার কতরকম টিস্পনী কাটলো। ভেবেছিলাম, অরবিন্দর বিয়েতে যাবোহাজার হোক বর-কনে দুজনেই আমার ফ্রেন্ড। কিন্তু বিয়ে মানেই তো বুঝতে পারিস।”
সোমনাথ চুপ করে রইলো। সুকুমার বললো, “আমি ভেবেছিলাম, খালি হাতেই একবার দেখা করে আসবো। সেই শুনে আমার বোনদের কি হাসি। বললো, “তোর কি লজ্জা-শরম কিছুই রইলো না দাদা? লুচি-মাংস খাবার এতেই লোভ যে শুধু হাতে বিয়ে বাড়ি যেতে হবে?
সোমনাথের বোন নেই। সুতরাং বোনেদের সঙ্গে ভাইদের কী রকম রেষারেষির সম্পর্ক হয় তা সে জানে না।
সুকুমার বললো, “কণাকেও দোষ দিতে পারি না। ওর বন্ধুর বিয়েতেও নেমন্তন্নের চিঠি এসেছিল। উপহার কিনতে পারা গেলো না তাই বেচারা যেতে পারলো না।”
সোমনাথ বললো, “অরবিন্দ ছেলেটার ক্রেডিট আছে বলতে হবে। বেস্ট-কীন-রিচার্ডসের মতো কোম্পানিতে চুকেছে।”
সোমনাথের কথা শুনে সুকুমার ফিক করে হেসে ফেললো। “ক্রেডিট ওর বাবার। আয়রন স্টীল কনট্রোলে বড় চাকরি করেন—ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছেন।”
একটু থৈমে সুকুমার বললো, তবে ভাই আমার রাগ হয় না।”
“কেন?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।
“ওদের ব্যাচে বারোজন ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি নিয়েছে তার মধ্যে অরবিন্দই একমাত্র লোকাল বয়। আর সব এসেছে হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং তামিলনাড়ু থেকে। সব ভাগ্যবানের পিছনে হয় মামা না-হয় বাবা আছেন! অথচ অরবিন্দ বলছিল, “কোনো ব্যাটা স্বীকার করবে না যে দিল্লীতে বড়-বড় সরকারী পোস্টে ওদের আত্মীয়স্বজন আছেন। সবাই নাকি নিজেদের বিদ্যে বুদ্ধি এবং মেরিটের জোরে বেস্ট-কীন-রিচার্ডসে ঢুকেছে। কলকাতার ছেলেদের তো কোনো মেরিট নেই!? জানিস সোমনাথ, এই বেস্ট-কীন-রিচার্ডস যেদিন ঝনঝনওয়ালা কিংবা বাজোরিয়ার হাতে যাবে, সেদিন দেখবি সমস্ত মেরিট আসছে রাজস্থানে ওঁদের নিজেদের গ্রাম থেকে।”
সোমনাথ ও সুকুমার দুজনেই গম্ভীর হয়ে উঠলো। তারপর একসঙ্গে হঠাৎ দুজনেই হেসে উঠলো। সুকুমার বললো, “আমরা আদার ব্যাপারী জাহাজের খোঁজ করে মাথায় রক্ত তুলছি কেন? আমরা তো অফিসার হতে চাইছি না। আমরা কেরানির পোস্ট চাইছি। আর আমার যা অবস্থা, আমি বেয়ারা হতেও রাজী আছি।”
০৫. আজকাল বাবাকে দেখলে কমলার কষ্ট হয়
আজকাল বাবাকে দেখলে কমলার কষ্ট হয়। ওপরের ওই বারান্দায় বসে অসহায়ভাবে ছটফট করেন ছোট ছেলের জন্যে।
আরামকেদারায় সোজাভাবে বসে দ্বৈপায়ন বললেন, “জানো বউমা, যে-কোনো একটা চাকরি হলেই আমি সন্তুষ্ট। খোকনের একটা স্থিতি প্রয়োজন।”
কমলা গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বললো, “নিশ্চয় স্থিতি হবে বাবা।”
“কোনো লক্ষণ তো দেখছি না, মা, গভীর দুঃখের সঙ্গে বললেন দ্বৈপায়ন।
চোখের চশমাটা খুলে সামনের টেবিলে রেখে দ্বৈপায়ন বললেন, “যার দাদারা ভালো চাকরি করে, তার পক্ষে একেবারে সাধারণ হওয়া বড় যন্ত্রণার। খোকন সেটা বোঝে কি না জানি না, কিন্তু আমার খুব কষ্ট হয়।”
কমলা অনেকবার ভেবেছে, দাদারা নিজেদের অফিসে সোমের জন্যে একটু চেষ্টা করে দেখুলেই পারে। আজ বশরের কাছে সেই প্রস্তাব তুললো কমলা।
দ্বৈপায়ন বললেন, “কথাটা যে আমার মাথায় আসেনি তা নয়। ভোম্বল এবং কাজল দুজনকেই খোঁজখবর করতে বলেছিলাম। কিন্তু উপায় নেই, নিজের ভাইকে অফিসে
কোলে ইউনিয়ন হৈ-চৈ বাধাবে। ভোম্বলের অফিসে তো বড় সায়েব গোপন সার্কুলার দিয়েছেন, কোনো অফিসারের আত্মীয়কে চাকরিতে ঢোকাতে হলে তাঁর কাছে পেপার পাঠাতে হবে। সোজাসুজি বলে দিয়েছেন ব্যাপারটা তিনি মোটেই পছন্দ করেন না।”