কমলা বললো, “বাবা, আপনাকে একটু হরলিকস এনে দেবে? আপনাকে আজ বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
দ্বৈপায়ন নিজের ক্লান্তি অস্বীকার করতে পারলেন না। বললেন, “কিছুই করি না, তবু আজকাল মাঝে মাঝে কেন যে এমন দুর্বল হয়ে পড়ি।”
কমলা বললো, “আপনি যে কারুর কথা শোনেন না, বাবা। দিনরাত খোকনের জন্যে চিতা করেন।”
দ্বৈপায়ন একটু লজ্জা পেলেন। মনে হলো পুত্রবধুর কাছে তিনি ধরা পড়ে গিয়েছেন।
কমলার মধ্যে কি মধুর আত্মবিশ্বাস। সে বললো, “আপনি শুধ-শুধু ভাবেন ওর জন্যে। আমার কিন্তু একটও চিতা হয় না। অত ভালো ছেলের ওপর ভগবান কখনও নির্দয় হতে পারেন না।”
বার্ধক্যের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দ্বৈপায়ন যদি বত্রিশ বছর বয়সের বউমার অর্ধেক বিশ্বাসও পেতেন তাহলে কি সুন্দর হতো। লক্ষ্মী-প্রতিমার মতো বউমার প্রশান্ত মুখের দিকে তাকালেন দ্বৈপায়ন।
ধীর শান্ত কণ্ঠে কমলা বললো, “ওঁর প্রমোশন অত তাড়াতাড়ি হচ্ছে বলে মনে হয় না। আর হলেও, খোকনের বিয়ে না দিয়ে আমি কলকাতা ছাড়ছি না।”
অনেক দুঃখের মধ্যেও দ্বৈপায়নের হাসি আসছে। ভাবলেন, একবার বউমাকে মনে করিয়ে দেন সুজি-রোজগার না থাকলে কোনো ছেলের বিয়ের কথা ভাবা যায় না। আড়াই বছর ধরে সোমনাথ চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক অ্যাপ্লিকেশন তিনি নিজে লিখে দিয়েছেন। প্রতিদিন তিনখানা করে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন তিনি তন্ন তন্ন করে দেখেন। সেগুলোতে লাল পেন্সিলে দাগ দেন প্রথমে। তারপর ব্লেড দিয়ে নিখুঁতভাবে কেটে পিছনে কাগজের নাম এবং তারিখ লিখে রাখেন।
দ্বৈপায়নের মনে পড়ে গেলো আজকের খবরের কাগজের কাটিংগুলো ওর কাছেই পড়ে আছে। কাটিংগুলো বউমার হাতে দিয়ে বললেন, সোমকে এখনই এগুলো দিয়ে দাও।”
বাবার উদ্বেগের কথাও বউমা জানে। আগামীকাল ভোরবেলায় বউমাকে জিজ্ঞেস করবেন, “কাটিংগুলো খোকনকে দিয়েছো তো? ও যেন বসে না থাকে। তাড়াতাড়ি অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে দেওয়া ভালো। দুটো অ্যাপ্লিকেশনে আবার তিন টাকার পোস্টাল অর্ডার চেয়েছে।”
কমলা জানে সোমকে ডেকে সোজাসুজি এসব কথা বলতে আজকাল বাবা পারেন না। দুজনেই অস্বস্তি বোধ করে। অনেক সময় বাবা ডাকলেও সোম যেতে চায় না। যাচ্ছি-যাচ্ছি করে একবেলা কাটিয়ে দেয়। কমলাকে দু’পক্ষের মধ্যে ছটোছুটি করতে হয়। কমলা বললো, “সোমকে আমি সব বুঝিয়ে বলে দিচ্ছি। পোস্টাল অর্ডারের টাকাও তো ওর কাছে দেওয়া ঘয়েছে।”
দ্বৈপায়ন তবুও নিশ্চিত হতে পারলেন না। ওঁর ইচ্ছে, সোমনাথ নাইট পোস্টাপিস থেকে এখনই পোস্টাল অর্ডার কিনে আনক এবং আধ ঘণ্টার মধ্যে অ্যাপ্লিকেশন টাইপ হয়ে যাক, যাতে কাল সকালেই রেজেস্ট্রি-ডাকে পাঠানো যায়।
কমলা বাবাকে শান্ত করবার জন্যে বললো, “দরখাস্ত নেবার শেষ দিন তো তিন সপ্তাহ পরে।”
নিজের অস্বস্তি চেপে রেখে দ্বৈপায়ন বললেন, “তুমি জানো না, বউমা, আজকাল ডাকঘরের যা অবস্থা হয়েছে, গিয়ে দেখবে একটাকা দু’টাকার পোস্টাল অর্ডার ফুরিয়ে গছে। তারপর রেজেস্ট্রি-ডাকের তো কথাই নেই। তিন ঘণ্টার পথ যেতে তিন সপ্তাহ লাগিয়ে দেয়। যারা চাকরির বিজ্ঞাপন দেয় তারাও ছুতো খুঁজছে। লাস্ট ডেটের আধঘণ্টা পরে চিঠি এলেও খুলে দেখবে না—একেবারে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেবে।”
নিজের ইচ্ছে যাই হোক, বউদির অনুরোধ এড়ানো যায় না। কমলা বউদি সোমনাথকে বললেন, “লক্ষ্মীটি সকালবেলাতেই পোস্টাপিসে অ্যাপ্লিকেশনটা রেজেস্ট্রি করে এসো–বাবা শুনলে খুশী হবেন। বুড়ো মানুষ, ওঁকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ?”
চিঠি ও খাম টাইপ করিয়ে সোমনাথ পোস্টাপিসের দিকে যাচ্ছিল। পোস্টাল অর্ডার কিনে ওখান থেকেই সোজা পাঠিয়ে দেবে।
পোস্টাপিসের কাছে সুকুমারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। সুকুমার চিৎকার করে বললো, “কী হে নবাব বাহাদুর, সকালবেলায় কোথায় প্রেমপত্তর ছাড়তে চললে?”
সোমনাথ হেসে ফেললো। “তোর কী ব্যাপার? দু-তিনদিন পাত্তা নেই কেন?”
“তুমি তো মিনিস্টারের সি-এ নও যে তোমার সঙ্গে আড্ডা জমাতে পারলে চাকরি পাওয়া যাবে। নিজের মাথার ব্যথায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। রাইটার্স বিল্ডিংসের ভিতরে ঢোকা আজকাল যা শক্ত করে দিয়েছে মাইরি, তোকে কী বলবো?”
“মিনিস্টারের সি-এরাই হয়তো চায় না বাজে লোক এসে জ্বালাতন করুক,” সোমনাথ বললো।
“সে বললে তো চলবে না, বাবা। মিনিস্টারের সি-এ যখন হয়েছে, তখন লোকের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। বিশেষ করে আমাদের মতো যারা এম-এল-এর গ্লু দিয়ে এসেছে তাদের এড়িয়ে যেতে পারবে না।”
সুকুমার এবার বললো, “চল তোর সঙ্গে পোস্টাপিসে ঘরে আসি। ভয় নেই তোর অ্যাপ্লিকেশনে ভাগ বসাতে যাচ্ছি না। তুই যেখানে খুশী চিঠি পাঠা, আমি বাগড়া দেবো না।”
এবার সুকুমার বললো, “তোকে কেন মিথ্যে বলবো, গত দু-দিন জি-পি-ওর সামনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকরির সাইক্লোস্টাইল করা ফর্ম বেঁচে টু-পাইস করেছি। কেরানির পোস্ট তো, হুড়-হুড় করে ফর্ম বিক্রি হচ্ছে মাইরি। এক ব্যাটা কাপুর তাল বুঝে হাজার হাজার ফর্ম সাইক্লোস্টাইল করে হোলসেল রেটে বাজারে ছাড়ছে। টাকায় দশখানা ফর্ম কিনলুম কাপুরের কাছ থেকে, আর বিক্রি হলো পনেরো পয়সা করে। তিরিশখানা ফর্ম বেঁচে পুরো দেড়টাকা পকেটে এসে গেলো।”
“কাপুর সায়েব তো ভালো বুদ্ধি করেছে,” সোমনাথ বললো।
সুকুমার বললো, “এদিকে কিন্তু কেলেংকেরিয়াস কাণ্ড। বাজারে কেউ জানে না—মিনিস্টারের সি-এর সঙ্গে দেখা না করতে গেলে আমার কানেও আসতো না। পনেরোটা পোস্টের জন্যে ইতিমধ্যে এক লাখ অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়েছে। সেই নিয়ে ডিপার্টমেন্টে প্রবল উত্তেজনা। টপ অফিসার দরবার মিনিস্টারের সি-এর সঙ্গে দেখা করে গেলো।”