তবু মনটা খারাপ হলো দ্বৈপায়নের। সুধন্যর জামাইয়ের বিদেশে যাওয়ার সময় পাসপোর্টের গোলমাল ছিল। সে-গোলমাল দ্বৈপায়নই সামলেছিলেন। খুকীর পাসপোর্ট তৈরির সময়েও দ্বৈপায়নকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। সুধন্য তখন অবশ্য ওর দুটো হাত ধরে বলেছিলেন, “তোমার ঋণ জীবনে শোধ করতে পারবো না।”
বিরক্তিটা সুধন্যর ওপর আর রাখতে পারছেন না দ্বৈপায়ন। মনে হচ্ছে, তিনকাল গিয়ে জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। এখনও তাঁকে সংসারের কথা ভাবতে হবে কেন? দ্বৈপায়নের অকস্মাৎ মনে হলো, পাশ্চাত্ত্য দেশের বাপ-মায়েরা অনেক ভাগ্যবান—তাঁদের দায়দায়িত্ব অনেক কম। মেয়ের বিয়ে এবং ছেলের চাকরি—এই দুটো বড় অশান্তি থেকে তাঁরা বেচেছেন।
সুধন্যবাবু বিদায় নেবার পরও দ্বৈপায়ন অনেকক্ষণ চুপচাপ বারান্দায় বসেছিলেন। বাইরে কখন অন্ধকার নেমে এসেছে। রাস্তা দিয়ে অফিসের লোকেরা ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরে এসেছে। মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি কেবল এ অঞ্চলের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছে।
“বাবা, আপনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন?” বড় বউমার ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলেন দ্বৈপায়ন।
সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারে সদ্যপ্রসাধিতা শ্রীময়ী বউমাকে দেখতে পেলেন দ্বৈপায়ন।
“এসো মা,” বললেন দ্বৈপায়ন।
“আপনি পান করবেন না, বাবা?” স্নিগ্ধ স্বরে কমলা জিজ্ঞেস করলো।
“এখানে বসে থাকলেই নানা ভাবনা মাথার মধ্যে এসে ঢোকে, বউমা। বড়োবয়সে কিছু, করবার ক্ষমতা থাকে না, কিন্তু ভাবনাটা রয়ে যায়। অথচ কী যে ভাবি, তা নিজেও অনেক সময় বুঝতে পারি না।”
“বাবা, বেশি রাত্রে স্নান করলে আপনার হাঁচি আসে। আপনি বরং ঠাণ্ডা জলে গা মুছে নিন,” শ্বশুরকে কমলা প্রায় হুকুম করলো।
দ্বৈপায়ন জিজ্ঞেস করলেন, “মেজ বউমা কোথায়?”
“কাজলের মেজ সায়েব নাইজিরিয়াতে বদলী হয়ে যাচ্ছেন—তাই পার্টি আছে। ওরা দুজন একটু আগেই বেরুলো। ফিরতে হয়তো দেরি হবে।”
দ্বৈপায়ন বললেন, “বিলিতী অফিসের এই একটা দোষ। অনেক রাত পর্যন্ত পার্টি করলে সায়েবরা খুশী হন না।”
কমলা শ্বশুরকে আশ্বাস দিলো, “এবার কমে যাবে। কারণ, নতুন মেজ সায়েব ইন্ডিয়ান।”
“কী নাম?” দ্বৈপায়ন জিজ্ঞেস করলেন।
“মিস্টার চোপরা, বোধহয়,” কমলা জানালো।
“ওরে বাবা! তাহলে বলা যায় না, হয়তো বেড়েও যেতে পারে।”
কমলা বললো, “সিধু নাপিতকে কাল আসতে বলে দিয়েছি, বাবা? অনেকদিন আপনার চুল কাটা হয়নি।
“কালকে কেন? পরশ, বললেই পারতে,” দ্বৈপায়ন মদ, আপত্তি জানালেন।
“পরশ, যে আপনার জন্ম বার, কমলা মনে করিয়ে দিলো। জন্ম বারে যে চুল ছাঁটতে নেই, এটা শাশুড়ীর কাছে সে অনেকবার শুনেছে।
দ্বৈপায়ন নিজের মনেই হাসলেন। তারপর বললেন, “চুল ছাঁটার কথা বলে ভালোই করেছো, বউমা। ঠিক সময়ে চুল ছাঁটা না হলে তোমার শাশুড়ী ভীষণ চটে উঠতেন।”
মুখ টিপে হাসলো কমলা। শ্বশুর-শাশুড়ীর ঝগড়া সে নিজের চোখে দেখেছে এবং নিজের কানে শুনেছে। শাশুড়ী রেগে উঠলে বলতেন, “যদি আমার কথা না শোনো তাহলে রইলো তোমার সংসার। আমি চললাম।”
শ্বশুরমশায় বলতেন, “যাবে কোথায়?”
শাশুড়ী ঝাঁঝিয়ে উঠতেন, “তাতে তোমার দরকার? যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যাবো।”
বাবার কী সেসব কথা মনে পড়ছে? নইলে উনি অমন অসহায়ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? মায়ের কথা ভেবে বাবা রাতের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
দ্বৈপায়ন নিজেকে শান্ত করে নিলেন। তারপর সস্নেহে বললেন, “ভোম্বলের কোনো খবর পেলে?”
স্বামী টারে গিয়েছেন বোম্বাইতে। কমলা বললো, “আজই অফিস থেকে খবর পাঠিয়েছেন। টেলেক্সে জানিয়েছেন, ফিরতে আরও দেরি হবে। হেড অফিসে কী সব জরুরী মিটিং হচ্ছে।”
দ্বৈপায়ন বললেন, “হয়তো ওর প্রমোশনের কথা হচ্ছে। টেকনিক্যাল ডিভিসনের ডেপটি ম্যানেজার হলে তো অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে হবে।”
কমলা চুপ করে রইলো। দ্বৈপায়ন বললেন, “জানো বউমা, আই অ্যাম প্রাউড অফ ভোম্বল। ওর জন্যে কোনোদিন একটা প্রাইভেট টিউটর পর্যন্ত আমি রাখিনি। নিজেই পড়াশুনা করেছে, নিজেই আই-আই-টিতে ভর্তি হয়েছে, নিজেই ফ্রি স্টুডেন্টশিপ যোগাড় করেছে, তারপর চাকরিটাও নিজের মেরিটে পেয়েছে। এগারো বছর আগে যখন তোমার সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক হলো, তখনও ভোম্বল ছিল একজন অর্ডিনারি টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট। আর চল্লিশে পা দিতে-না-দিতে ডেপুটি ম্যানেজার।”
হঠাৎ চুপ করে গেলেন দ্বৈপায়ন। তিনি কি ভাবছেন কমলা তা সহজেই বলতে পারে। সোমনাথের কথা চিন্তা করে তিনি যে হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন, তা কমলা বুঝতে পারছে। যোধপুর পার্কের এই বাড়ির একটা ভবিষ্যৎ কল্পনাচিত্র যে দ্বৈপায়নের মনে মাঝে মাঝে উঁকি মারে তা কমলার জানা আছে।
ছবিটা এইরকম। ভোল বোঘাই বদলি হয়েছে। বউমাকেও স্বামীর সঙ্গে যেতে হয়েছে। যাবার আগে সে বাবাকে নিয়ে যাবার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছে। বাবা রাজী হননি। কাজলও বদলি হয়েছে আমেদাবাদে। আর মেজ বউমা (বুলবুল) তো স্বামীর সঙ্গে যাবার জন্যে এক-পা বাড়িয়েই আছে। তখন এ-বাড়িতে কেবল দ্বৈপায়ন এবং সোমনাথ।
বড় বউমার দিকে অসহায়ভাবে তাকালেন দ্বৈপায়ন। কিন্তু কোনো কথা বললেন না। সঞ্চয় বলতে তাঁর বিশেষ কিছুই নেই—মাত্র হাজার দুয়েক টাকা। আর পেনসন, সে তো তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর সোমনাথ কী করবে? এ-বাড়িটাও তরি নিজস্ব নয়। দোতলা করবার সময় ভোম্বল ও কাজল দুজনেই কিছু কিছু টাকা দিয়েছে। কাজলের মাইনে থেকে এখনও কো-অপারেটিভের ঋণের টাকা মাসে মাসে কাটছে।