দ্বৈপায়ন ছেলেদের সব খবরাখবর রাখেন। ছেলেরা এসে অফিস সম্পর্কে বাবার সঙ্গে আলোচনা করে। দ্বৈপায়ন বললেন, “ভোম্বল এ-বছরেই টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ম্যানেজার হবে শুনেছি। ছোকরা নিজের চেষ্টায় সামান্য টাকায় ঢুকেছিল, চাকরিতে এতোটা উঠবে আশা করিনি। কিন্তু বিয়ের পরই উন্নতি হচ্ছে—বউমার ভাগ্য।”
বউমা সম্পর্কে কোথাও কোনোরকম মতদ্বৈধ নেই। সুধন্যবাবু বললেন, “গিন্নি এবং আমি তো প্রায়ই বলি, সাক্ষাৎ লক্ষ্মীকে তুমি ঘরে নিয়ে এসেছে—নামে কমলা, স্বভাবেও কমলা।”
দ্বৈপায়নের থেকে এ-বিষয়ে কেউ বেশি বোঝে না। তিনি কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “বড় বউমা না থাকলে সংসারটা ভেসে যেতো ধন্য। আজকালকার মেয়েদের সম্বন্ধে যা সব শুনি?”
পা নাড়াতে নাড়াতে সুধন্যবাবু বললেন, “আজকাল মেয়েরা যে রসাতলে যাচ্ছে তা হয়তো ঠিক নয়। তবে স্বামীরটি এবং নিজেরটি ছাড়া অন্য কিছুই বোঝে না। সুপুরুষ রোজগেরে স্বামীটি যে ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সে আকাশ থেকে বেলুনে চড়ে মাটিতে নেমে আসেনি, অনেক দুঃখকষ্টে পেটে ধরে কেউ যে তাকে তিলতিল করে মানুষ করেছেন এবং তাঁদেরও যে সন্তানের ওপর কিছু দাবি আছে, তা বউদের মনে থাকে না।”
দ্বৈপায়ন বললেন, “এই ডেপুটি ম্যানেজার হবার খবরে বউমা কিন্তু খুব চিন্তিত।”
“সে কি?” অবাক হয়ে গেলেন সুধন্যবাবু। “প্রমোশন, এ তো আনন্দের কথা।”
“প্রমোশন পেলে ভোম্বলকে হেড অফিসে বদলি করে দেবে,” একটু থামলেন দ্বৈপায়ন। “মা আমার কথা কম বলে, কিন্তু বুদ্ধিমতী। কমলা-বিহীন এ-সংসারের কী হবে তা নিশ্চয় বুঝতে পারো।”
“কেন? মেজ বউমা?” সুধন্যবাবু প্রশ্ন করেন।
দ্বৈপায়ন ঝকে পড়েন সামনের দিকে। নিচু গলায় বললেন, “এখনও ছেলেমানুষ। মনটি ভালো, কিন্তু প্রজাপতির মতো ছটফট করে—একজায়গায় মন স্থির করতে পারে না। তাছাড়া কাজলের তো ঘন ঘন ট্রান্সফারের কাজ। আমেদাবাদ পাঠিয়ে দেবার কথা হচ্ছে।”
সুধন্যবাবু কিছু বলার মতো কথা পাচ্ছেন না। দ্বৈপায়ন নিজেই বললেন, “এমনও হতে পারে যে এই বাড়িতে কেবল আমি এবং খোকন রয়ে গেলাম।”
কপালে হাত রাখলেন দ্বৈপায়ন। “আমি আর ক’দিন? কিন্তু সংসারটা গুছিয়ে রেখে যেতে পারলাম না, সুধন্য। প্রতিভার সঙ্গে দেখা হলে বকাবকি করবে। বলবে, দুটো ছেলেকে মানুষ করে, মাত্র একজনের দায়িত্ব তোমার ওপরে দিয়ে এলাম, সেকাজটাও পারলে না?”
চাকরির যে এমন অবস্থা হবে, তা কি কেউ কল্পনা করেছিল?” বন্ধুকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন সুধন্যবাবু। “শুধু তোমার ছেলে নয়, যেখানে যাচ্ছি সেখানেই হাহাকার। হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ নয়, এখন শুনছি বেকারের সংখ্যা লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে কোটিতে হাজির হয়েছে।”
দ্বৈপায়ন শুধু বললেন, “হুঁ।” এই শব্দ থেকে তাঁর মনের সঠিক অবস্থা বোঝা গেলো না।
সুধন্যবাবু বললেন, “এখন তো আর কাজকর্ম নেই—মন দিয়ে খবরের কাগজটা পড়ি। কাগজে লিখছে, এতো বেকার পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। এই একটা ব্যাপারে আমরা নিঃসন্দেহে ফার্স্ট হয়েছি—দুনিয়ার কোনো জাত অদর ভবিষ্যতে আমাদের এই সম্মান থেকে সরাতে পারবে না। ইন্ডিয়ার মধ্যে আবার আমরা বাঙালীরা বেকারীতে গোল্ড মেডেল নিয়ে বসে আছি।”
আরামকেদারায় শুয়ে দ্বৈপায়ন আবার বললেন, “হুঁ।”
সুধন্যবাবু বললেন, “জিনিসটা বীভৎস। লেখাপড়া শিখে, কত স্বপ্ন কত আশা নিয়ে লাখ লাখ স্বাস্থ্যবান ছেলে চুপচাপ ঘরে বসে আছে, আর মাঝে মাঝে কেবল দরখাস্ত লিখছে—এ দৃশ্য ভাবা যায় না। সমস্যাটা বিশাল বুঝলে দ্বৈপায়ন। সুতরাং তুমি একলা কী করবে?”
মন তবু বুঝতে চায় না। দ্বৈপায়নের কেমন ভয় হয়, প্রতিভার সঙ্গে দেখা হলে এইসব যক্তিতে সে মোটেই সন্তুষ্ট হবে না। বরং বলে বসবে, তুমি-না বাপ? মা-মরা ছেলেটার জন্যে শুধু খবরের কাগজী লেকচার দিলে!
সুধন্যবাবু বললেন, “সারাজন্ম খেটেখুটে পেনসন নিয়ে যে একটু নিশ্চিন্তে জীবন কাটাবে তার উপায় নেই। ছেলেরা মানুষ না হলে নিজেদের অপরাধী মনে হয়।”
সুধন্যবাবু উঠতে যাচ্ছিলেন। দ্বৈপায়ন বললেন, “এ-সম্বন্ধে তোমার মেয়ে একবার কি লিখেছিল না?”
সুধন্যবাবু আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “একবার কেন? মেয়ে প্রায়ই লেখে। ওখানকার পলিসি হলো—নিজের বর নিজে খোঁজো-–ওন-ইওর-ওন টেলিফোনের মতো। ইচ্ছে হলে বড়জোর বাপ-মাকে কনসাল্ট করো। কিন্তু দায়িত্বটা তোমার। তেমনি চাকরি খুঁজে দেবার দায়িত্ব বাপ-মায়ের নয়! তোমার গোঁফ-দাড়ি গুজিয়েছে, সাবালক হয়েছে–এখন নিজে চরে খাও।”
সোমনাথের কথা সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেলো দ্বৈপায়নের। মনের সঙ্কোচ ও দ্বিধা কাটিয়ে তিনি বললেন, “ভাবছিলাম, খোকনের জন্যে কানাডায় কিছু করা যায় কিনা। এখানে চাকরি-বাকরির যা অবস্থা হলো।”
সুধন্যবাবু কোনো আশা দিতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত দায়সারাভাবে উত্তর দিলেন, “তুমি যখন বলছো, তখন খুকীর কাছে আমি সব খুলে লিখতে পারি। কিন্তু আমি যতদর জানি, প্রতি হপ্তায় কলকাতা থেকে এধরনের অনুরোধ জামাইয়ের কাছে দু-তিনখানা যায়। কানাডিয়ানরা আগে অনেক ইন্ডিয়ান নিয়েছে—এখন ওরা চালাক হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার, ইনজিনীয়ার, টেকনিশিয়ান ছাড়া আর কাউকে কানাডায় ঢোকবার ভিসা দিচ্ছে না।”
দ্বৈপায়ন এই ধরনের উত্তর পাবার জন্যেই প্রস্তুত ছিলেন। কানাডাকে তিনি দোষ দিতে পারেন না। ঢালাও দরজা খুলে রাখলে, কানাডার অবস্থা এ-দেশের মতো হতে বেশি সময় লাগবে না।