অথচ কত লোক এই সময়ে অফিসে, আদালতে, কারখানায়, রেল স্টেশনে, পোস্টাপিসে, বাজারে কাজ করতে করতে গলদঘর্ম হচ্ছে। মা বলেছিলেন, কাউকে হিংসে করবে নাকিন্তু এই মুহূর্তে কাজের লোকেদের হিংসে না করে পারছে না সোমনাথ।
০৪. বাবার বন্ধু সুধন্যবাবু
সাড়ে-চারটের সময় বাবার বন্ধু, সুধন্যবাবু এলেন। রিটায়ার করে তিনি এখানেই বাড়ি কিনেছেন। বিকেলের দিকে সুধন্যবাবু মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে গল্প করতে আসেন।
সুধন্যবাবু এলেই বাবার গাম্ভীর্যের মুখোস খসে যায়। বউমার কাছে চায়ের অনুরোধ যায়। তারপর দুজনের সুখ-দুঃখের গল্প শুরু হয়।
সুধন্যবাবুর দিকে সিগারেট এগিয়ে দিয়ে দ্বৈপায়ন জিজ্ঞেস করেন, “চিঠিপত্তর পেলে!” চিঠিপত্তর মানে জামাই-এর চিঠি-সুধন্যবাবুর জামাই কানাডায় থাকে।
সুধন্যবাবু বলেন, “জানো ব্রাদার, এখানে তো এতো গরম, কিন্তু উইনিপেগে এখন বরফ পড়ছে। খুকী লিখেছে, রাস্তায় হাঁটা যায় না।”
“ওদের আর হাঁটবার দরকার কী? গাড়ি রয়েছে তো?” দ্বৈপায়নবাব জিজ্ঞেস করেন।
“শুধু গাড়ি নয়—এয়ার কন্ডিশন লিমুজিন। শীতকালে গরম, গরমকালে ঠাণ্ডা। এখানে বিড়লারাও অমন গাড়ি চড়তে পায় কিনা সন্দেহ। জামাইবাবাজী গাড়ির একটা ফটো পাঠিয়েছে, তোমাকে দেখাবো’খন। জানো দ্বৈপায়ন, এমন গাড়ি যে গিয়ার চেঞ্জ করতে হয় না—সব আপনা-আপনি হয়। আর আমাদের এখানে দেশী কোম্পানির গাড়ি দেখো! সেবার খুকী যখন এলো, তখন আমার নাতনী তো ট্যাক্সিতে চড়ে হেসে বাঁচে না। তাও বেছে-বেছে নতুন ট্যাক্সিতে উঠেছিলাম আমরা।”
“কাদের সঙ্গে কাদের তুলনা করছে, সুধন্য?” দ্বৈপায়ন সিগারেটে টান দিয়ে বলেন। এ-দেশের অর্থনৈতিক ক্রমাবনতি সম্পর্কে দ্বৈপায়নের বিরক্তি ওঁর প্রতিটি কথায় প্রকট হয়ে উঠলো।
সুধন্যবাবু এবার সগর্বে ঘোষণা করলেন, “খুকী লিখেছে, জামাইয়ের মাইনে আরও বেড়েছে। এখন দাঁড়ালো, এগারো হাজার দশো পঞ্চাশ টাকা।” জানো ব্রাদার, গিন্নি তো এখনও সেইরকম সিম্পল আছেন—উনি ভেবেছেন বছরে এগারো হাজার টাকা। বিশ্বাসই করতে চান না, প্রতি মাসে জামাইবাবাজী এতো টাকা ঘরে আনছে। আমি রসিকতা করলাম, “গিন্নি একি তোমার স্বামী যে এগারো শো টাকায় রিটায়ার করবে।”
“আহা বেঁচে থাক, আরও উন্নতি করুক,” দ্বৈপায়ন আশীর্বাদ জানালেন।
সুধন্যবাবু কিন্তু পুরোপুরি খুশী নন। বললেন, “খুকীর অবশ্য সখ নেই। লিখেছে, এমন অভাগা দেশ যে একটা ঠিকে-ঝি পর্যন্ত পাওয়া যায় না। জানো দ্বৈপায়ন, আদরের মেয়েটাকে জমাদারণীর কাজ পর্যন্ত করতে হয়। অবশ্য জামাইবাবাজী হেল্প করে।”
“বলো কী?” দ্বৈপায়ন সহানুভূতি প্রকাশ করেন।
“লোকের বড় অভাব, জানো দ্বৈপায়ন। কত চাকরি যে খালি পড়ে আছে, শুধু লোক পাওয়া যাচ্ছে না বলে।” সুধন্যবাবু সিগারেটে একটা টান দিলেন।
দ্বৈপায়ন কী মতামত দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সিগারেটের ছাই ঝেড়ে তিনি বললেন, “রূপকথার মতো শোনাচ্ছে সুধন্য। বিংশ শতাব্দীতে একই চন্দ্র-সূর্যের তলায় এমন দেশ রয়েছে যেখানে একটা পোস্টের জন্য এক লাখ অ্যাপ্লিকেশন পড়ে, আবার অন্য দেশে চাকরি রয়েছে কিন্তু লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
সুধন্যবাবু বন্ধুর মতো বিস্ময়বোধ করলেন না। বললেন, “তবে কি জানো, দুটোই চরম অবস্থা। যে-দেশে নিজের বাসন নিজে মেজে খেতে হয় সে দেশকে ঠিক সুসভ্য দেশ বলা চলে না।”
হাসলেন দ্বৈপায়ন। “কিন্তু যাদের বাড়িতে বেকার ছেলে রয়েছে তারা বলছে, পশ্চিম যা করেছে তাই শতগুণে ভালো। এদেশে চাকরি-বাকরির যা অবস্থা হলো।”
সুধন্যবাবু বললেন, “ভাগ্যে আমার ছেলে নেই, তাই চাকরি-বাকরির কথা এ-জীবনে আর ভাবতে হবে না।”
“বেঁচে গেছ, ব্রাদার। ছোকরা বয়সের এই যন্ত্রণা চোখের সামনে দেখতে পারা যায় না। অথচ হাত-পা বাঁধা অবস্থা-সাহায্য করবার কোনো ক্ষমতা নেই।” দ্বৈপায়নের কণ্ঠে দুঃখের সুর বেজে উঠলো।
“এই অবস্থায় জামাই-এর মাথায় ভূত চেপেছে,” সুধন্যবাবু, ঘোষণা করলেন, “বিদেশে থাকলে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা বাড়ে তো। লিখেছে, দেশে ফিরে গিয়ে দেশের সেবা করবো। বলো দিকিনি, কি সর্বনাশের কথা!”
কথাটা যে মোটেই সুবিধের নয় এ-বিষয়ে দ্বৈপায়ন বন্ধুর সঙ্গে একমত হলেন।
সুধন্যবাবু বললেন, “সেইজন্যেই তো তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে এলাম। জামাই লিখেছে, হাজার টাকা মাইনে পেলে দেশের কোনো কলেজে লেকচারার হয়ে ফিরে যাবো। বাবাজী অনেকদিন ঘরছাড়া, বুঝতে পারছে না ইন্ডিয়াতে এতো লোক যে এখানে মানুষের কোনো সম্মান নেই। মানুষের এই জঙ্গলে মানুষকে যোগ্য মূল্য দিতে ভুলে গিয়েছি আমরা।”
দ্বৈপায়ন বললেন, “মেয়েকে লিখে দাও, জামাইয়ের কথায় যেন মোটেই রাজী না হয়। এখানে এসে ওরা শুধু ভিড় বাড়বে, তিন-চারখানা বাড়তি রেশন কার্ড হবে, অথচ দেশের কোনো মঙ্গল হবে না। তার থেকে ঐ যে বৈদেশিক মুদ্রা জমাচ্ছে, ওতে দেশের অনেক উপকার হচ্ছে।”
সুধন্যবাবুর মনের মধ্যে কোথাও একট লোভ ছিল মেয়েকে অতদরে না রাখার। চাপা গলায় বললেন, “তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, গিন্নির চোখে জল। হাজার হোক একটি সন্তান কোথায় পড়ে রয়েছে। ওঁর ইচ্ছে, মেয়েজামাই ফিরে আসুক—অত টাকা নিয়ে কী হবে? এতো লোক তো এই দেশেই করে খাচ্ছে, গাড়ি চড়ছে, ভালো বাড়িতে থাকছে।”
একটু থেমে সুধন্যবাবু বললেন, “সেদিক থেকে তুমি ভাই লাকি। হীরের টুকরো সব ছেলে। ডোম্বলের আর কোনো প্রমোশন হলো নাকি?”।