“তাহলে উপায়?” মোমনাথ চিন্তিত হয়ে পড়ে।
“তাদের উপায় তারা বুঝবে, আমাদের কী? তা যা বলছিলাম, এই পঙ্গপালের ভয়ে অনেক কোম্পানি এখন বিজ্ঞাপন না দিয়ে নোটিশ বোর্ডে চাকরির খবর কলিয়ে দিচ্ছে। আমাদের শম্ভু দাস, ছোকরা এইরকমভাবে হাইড রোডের একটা কারখানায় টাইপিস্টের চাকরি বাগিয়েছে। ছোকরার অবশ্য টাইপে পীড ছিল। বেটাকে একদিন দেখেছিলাম মেশিনের ওপর। পাঞ্জাব মেলের মতো আঙুল চলছে। ওর কাছ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে আমিও এখন আপিসে-আপিসে ঘুরে বেড়াই। মুখে কিছু বলি না—চাকরির খোঁজে এসেছি জানতে পারলে অনেক আপিসে আজকাল ঢুকতে দেয় না। তাই কোনো কাজের অছিলায় ডাঁটের মাথায় আপিসে ঢুকে পড়তে হয়, তারপর একটু ব্রেন খাটিয়ে স্টাফদের নোটিশ বোর্ডে নজর বুলিয়ে আসি।”
একটু থামলো সুকুমার। তারপর বললো, “ভাবছিস পণ্ডশ্রম হচ্ছে? মোটেই না। চারে মাছ আছে, বুঝলি সোমনাথ? এর মধ্যে তিন-চারখানা অ্যাপ্লিকেশন ছেড়ে এসেছি। কাল যে আপিসে গিয়েছিলাম, সেখানে চাকরি হলে কেলেংকারিয়াস কাণ্ড। প্রত্যেক দিন মাইনে ছাড়াও পচাত্তর পয়সা টিফিন—তাও বাবুদের পছন্দ হচ্ছে না। প্রতিদিন আড়াই টাকা টিফিনের দাবিতে কর্মচারি ইউনিয়ন কোম্পানিকে উকিলের চিঠি দিয়েছে।”
গোলপার্ক থেকে এক বাড়ি ফিরে আসার পথে সুকুমারের কথা ভাবছিল সোমনাথ। ওর উদ্যমকে মনে মনে প্রশংসা না করে পারে নি সোমনাথ। হয়তো এই পরিশ্রমের ফল সুকুমার একদিন আচমকা পেয়ে যাবে। চাকরির নিয়োগপত্রটা দেখিয়ে, সুকুমার চলে যাবে, কেবল সোমনাথ তখনও বেকার বসে থাকবে। এসব বুঝেও সোমনাথ কিন্তু সুকুমারের মতো হতে পারবে না।
বাবা সরকারী কাজ করতেন, একসময় অনেককে চিনতেন। কিন্তু সোমনাথ কিছুতেই তাঁদের বাড়ি বা অফিসে গিয়ে ধর্না দেবার কথা ভাবতে পারে না। বাবারও আত্মসম্মানজ্ঞান প্রবল—কিছুতেই বন্ধু-বান্ধবদের ধরেন না। দ্বৈপায়নবাবর যে একটা পাস কোর্সে বি-এ পাসকরা বেকার অর্ডিনারি ছেলে আছে সে খবর অনেকেই রাখে না। তাঁরা শুধু দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির দুই হীরের টুকরো ছেলের কথা শুনেছেন—যাদের একজন আই-আই-টি ইনজিনীয়ার এবং আরেকজন বিলাতী কোম্পানির জনিয়ার অ্যাকাউনটেন্ট।
হঠাৎ সোমনাথের রাগ হতে আরম্ভ করছে। সুকুমার বেচারা অত দুঃখী, কিন্তু কারুর ওপর রাগে না। সোমনাথের এই মুহূর্তে রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছে। এই যে বিশাল সমাজ তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধই তো সোমনাথ বা তার বন্ধ, সুকুমার করেনি। তারা সাধ্যমতো লেখাপড়া শিখেছে, সমাজের আইন-কানুন মেনে চলেছে। তাদের যা করতে বলা হয়েছে তারা তাই করেছে। তাদের দেহে রোগ নেই, তারা পরিশ্রম করতে রাজী আছে—তবু এই পোড়া দেশে তাদের জন্যে কোনো সুযোগ নেই। এমন নয় যে তারা বড় চাকরি চাইছে—যে-কোনো কাজ তো তারা করতে প্রস্তুত। তবু কেউ ওদের দিকে মুখ তুলে তাকালো—মাঝখান থেকে জীবনের অমূল্য দুটো বছর নষ্ট হয়ে গেলো।
একবার যদি সোমনাথ বুঝতে পারতো এর জন্যে কে দায়ী, তাহলে সত্যিই সে বেপরোয়া একটা কিছু করে বসতো। সুকুমার বেচারা হয়তো তার সঙ্গে যোগ দিতে সাহস করবে না—ওর দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। কিন্তু সোমনাথের পিছ, টান নেই। ওর পক্ষে বেপরোয়া হয়ে বোমার মতো ফেটে পড়া অসম্ভব নয়।
বাড়ি ফিরতেই কমলা বউদি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কারুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নাকি? মুখ অমন লাল হয়ে রয়েছে।”
সোমনাথ সামলে নিলো নিজেকে। বললো, “বোধহয় একটু রোদ লেগেছে।”
বুলবুল অনেক আগেই চেতলায় বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছে। ওখানে ভাত খাবে সে। বাবা পুরানো অভ্যাস অনুযায়ী সাড়ে দশটার সময় ভাত খেয়ে নিয়েছেন। শুধু বউদি সোমনাথের জন্যে অপেক্ষা করছেন।
তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিলো সোমনাথ। তারপর দুজনে একসঙ্গে খেতে বসলো। মায়ের মৃত্যুর পর এই এতো বছর ধরে সোমনাথ কতবার কমলা বউদির সঙ্গে খেতে বসেছে। রান্না পছন্দ না হলে বউদিকে বকুনি লাগিয়েছে। বলেছে, “বাবা কিছু বলেন না, তাই বাড়ির রান্না ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।”
কমলা বউদিও দেওরের সঙ্গে তর্ক করেছেন। বলেছেন, “তেল-ঝাল না থাকলে তোমাদের রান্না ভালো লাগে না। কিন্তু বাবা ওসব সহ্য করতে পারেন না। ডাক্তারবাবু বলে গেছেন, লঙ্কা আর অতিরিক্ত মসলা কারুর শরীরের পক্ষে ভালো নয়।”
কিন্তু এই দু-বছরেই অবস্থাটা ক্রমশ পালটে গেলো। সোমনাথ এখন খেতে বসে কেমন যেন লজ্জা পায়! রান্নার সমালোচনা তো দূরের কথা, বিশেষ কোনো কথাই বলে না। আর কমলা বউদি দঃখ করেন, “তোমার খাওয়া কমে যাচ্ছে কেন, খোকন? হজমের কোনো গোলমাল থাকলে ডাক্তার দেখিয়ে এসো। একটু-আধট, ওষধ খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সোমনাথ প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। ওর কেমন ভয় হয় কমলা বউদির কাছে কিছুই গোপন থাকে না। বউদি ওর মনের সব কথা বোধহয় বুঝতে পারেন।
অপরাহ্নের পরিস্থিতি আরও যন্ত্রণাদায়ক। জন্ম-জন্মান্তর ধরে কত পাপ করলে তবে এই সময় বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকবার শান্তি পায় পুরষ মানুষেরা।
কমলা বউদি সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর এই সময় একটু নিজের ঘরে বিছানায় গড়িয়ে নেন। বিনাশ্রম কারাদণ্ডের এই সময়টা সোমনাথ কীভাবে কাটাবে বুঝতে পারে না। এই সময় ঘুমোলে সারারাত বিছানায় ছটফট করতে হয়। চুপচাপ জেগে থাকলে, মনে নানা কিম্ভূতকিমাকার চিন্তা ভিড় করে। মাঝে-মাঝে বই পড়বার চেষ্টা করেছে সোমনাথ-এখন বই ভালো লাগে না। আগে ট্রানজিস্টর রেডিওতে গান শুনতো—এখন তাও অসহ্য মনে হয়।