“উনি কী বললেন?” সোমনাথ জানতে চাইলো।
“খুব ইমপ্রেস্ড হলেন। বললেন, সবার কাছ থেকে এ-রকম সহযোগিতা পেলে ওঁরা দেশে সোনা ফলিয়ে দেবেন। ভরসা পেয়ে তোর কথাটাও ওঁর কানে তুলে দিয়েছি। বলেছি, হাজার হাজার লাখ লাখ চাকরি যখন আপনার হাতে আসছে, তখন আমার বন্ধু, সোমনাথ ব্যানার্জির নামটাও মনে রাখবেন। খুব ভালো ছেলে, আমারই মতো চাকরি না পেয়ে বেচারা বড় মনমরা হয়ে আছে। চেয়ারের জন্যে কোনো অসুবিধা হবে না। ওদের বাড়িতে অনেক খালি চেয়ার আছে।”
সোমনাথ হাসলো।
সুকুমার একটু বিরক্ত হয়ে বললো, “এইজন্যে কারুর উপকার করতে নেই। দাঁত বার করে হাসছিস কি? এম-এল-এ-দা বলেছেন, শীগগির একদিন রাইটার্স বিল্ডিংস-এ নিয়ে যাবেন। খোদ মিনিস্টারের সি-এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন। সি-এ জানিস তো? মিনিস্টারের গোপন সহকারী কনফিডেনশিয়াল অ্যাসিসট্যান্ট। আজকাল এরা ভীষণ পাওয়ারফুল—আই-সি-এস খোদ সেক্রেটারীরা পর্যন্ত সি-এদের কাছে কেঁচো হয়ে থাকে।”
“তাতে তোর-আমার কী? বড় বড় গরমেন্ট অফিসাররা চিরকালই কারুর কাছে গোখরো সাপ, কারুর কাছে পাঁকাল মাছ।” সোমনাথ আই-এ-এস এবং আই-সি-এস সম্বন্ধে তার বিরক্তি প্রকাশ করলো।
সুকুমার কিন্তু নিরুৎসাহ হলো না। বন্ধুর হাত চেপে বললো, “আসল কথাটা শোন না। সি-এদের পকেটে ছোট একটা নোটবক থাকে। ওই নোটবকে যদি একবার নিজের নাম-ঠিকানা তোলাতে পেরেছিস স্রেফ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সরকারী চাকরি পেয়ে যাবি।”
“তুই চেষ্টা করে দেখ! তদ্বিরের জন্য জুতোর হাফসোল খুইয়ে ফেলে আমার চোখ খুলে গিয়েছে, সোমনাথ বিরক্তির সঙ্গে বললো।
সুকুমার বললো, “আশা ছাড়িস না। ট্রাই ট্রাই অ্যান্ড ট্রাই। একবারে না পারিলে দেখো শতবার।”
“শতবার! শালা সহস্রবারের ওপর হয়ে গেলো, কিছু, ফল হলো না। মাঝখান থেকে রয়াল টাইপ রাইটিং কোম্পানির নবীনবাব বড়লোক হয়ে গেলেন। আমার কাছ থেকে কত বার যে পঞ্চাশ পয়সা করে চিঠি ছাপাবার জন্যে বাগিয়ে নিলেন। আমি মতলব করেছিলুম, কার্বন কাগজ চড়িয়ে অনেকগুলো কপি করে রেখে দেবো, বিভিন্ন নামে ছাড়বো। কিন্তু বাবা এবং বউদি রাজী হলেন না। বললেন, অ্যাপ্লিকেশনটাই নাকি সবচেয়ে ইমপর্টান্ট। ওর থেকেই ক্যান্ডিডেট সম্পর্কে মালিকরা একটা আন্দাজ করে নেয়। কার্বন কপি দেখলে ভাববে লোকটা পাইকিরী হারে অ্যাপ্লিকেশন ছেড়ে যাছে।”
“এটা মাইরি অন্যায়,” সুকুমার এবার বন্ধুর পক্ষ নিলো। “তোমরা একখানা চাকরির জন্যে হাজার হাজার দরখাস্ত নেবে, আর আমরা দশ জায়গায় একই দরখাস্ত ছাড়তে পারবো না?”
সোমনাথ বললো, “আসলে বউদির খেয়াল। টাইপ করার পয়সাও হাতে গুঁজে দিচ্ছেন, বলার কিছু নেই। তবে এখন বুঝতে পারছি সরকার-বেসরকার কেউ আমাদের চাকরি দিয়ে উদ্ধার করবে না?”
“ভগবান জানেন,” সুকুমার রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের মনেই বললো। অফিসযাত্রীর ভিড় ইতিমধ্যেই অনেকটা পাতলা হয়ে এসেছে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সোমনাথ একবার বললো, “আমার বউদি কিন্তু মোটেই আশা হাড়েনি। আমার কোঠিতে নাকি আছে যথাসময়ে অনেক টাকা রোজগার করবো।”
“আমার ভাই কোঠি নেই। থাকলে একবার ধনস্থানটা বিচার করিয়ে নেওয়া যেতো।” সুকুমার বললো।
সোমনাথ আবার বউদির কথা তুললো। “সেদিন চুপচাপ বসেছিলাম। বউদি বললেন, ‘মন খারাপ করে কী হবে? ছেলেদের চাকরিটা অনেকটা মেয়েদের বিয়ের মতো। বাবা আমার বিয়ের জন্যে কত ছটফট করেছেন। কত বাড়িতে ঘোরাঘুরি করেছেন। কিছুতেই কিছু হয় না। তারপর যখন ফল ফুটলো, এ-বাড়িতে এক সপ্তাহের মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে গেলো।” বউদি বলেছিলেন, “আমার চাকরির ফল হয়তো একদিন হঠাৎ ফুটে উঠবে, লোকে হয়তো ডেকে চাকরি দেবে।”
“তোর বউদির মুখে ফল-চন্দন পড়ুক। জন মাসের মধ্যে যদি আমার ফুল ফোটে তাহলে বড় ভালো হয়, হাতে পুরো একটা মাস থাকে।” সুকুমার নিজের মনেই বললো।
“ফুল তো তোর আমার চাকর নয়। নিজের যখন ইচ্ছে হবে তখন ফুটবে!” সোমনাথ উত্তর দিলো।
সুকুমার এবার মনের কথা বললো। “বড্ড ভয় করে মাইরি। আমাদের কলোনিতে আইবুড়ী দেঁতো পিসী আছে। বিয়ের সম্বন্ধ করতে করতেই পিসী বুড়ী হয়ে গেলো–বর আর জুটলো না। আমাদের যদি ওরকম হয়? চুল-দাড়ি সব পেকে গেলো অথচ চাকরি হলো না!”
এরকম একটা ভয়াবহ সম্ভাবনা যে নেই, তা মোটেই জোর করে বলা যায় না। এই ধরনের কথা শুনতে সোমনাথের তাই মোটেই ভালো লাগে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সোমনাথ বললো, “এবার বাড়ি ফেরা যাক। বউদি বেচারা হয়তো জলখাবার নিয়ে বসে আছেন।”
“যা তুই জলখাবার খেতে। আমি এখন বাড়ি ফিরবো না। একবার আপিসপাড়াটা ঘুরে আসবো।”
“আপিসপাড়ায় ঘরে কী তোর লাভ হয়? কে তোকে ডেকে চাকরি দেবে?” সোমনাথ বন্ধুর সমালোচনা করলো।
কিন্তু সুকুমার দমলে না। “সব গোপন ব্যাপার তোকে বলবো কেন? ভাবছিস ফর নাথিং এই সেকেন্ড ক্লাস ট্রামের ভিড় ঠেঙিয়ে আমি আপিসপাড়ায় ভেরেণ্ডা ভাজতে যাচ্ছি? সুকুমার মিত্তিরকে অত বোকা ভাবিস না।”
সোমনাথের এবার কৌতূহল হলো। বন্ধুকে অনুরোধ করলো, “গোপন ব্যাপারটা একটু খুলে বল না ভাই।”
“এবার পথে এসো দাদা! বেকারের কি দেমাক মানায়? বাড়িতে বসে শুধু খবরের কাগজ পড়লেই চাকরির গোপন খবর পাওয়া যায় না, চাঁদ।”
“তাহলে?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করে।
সুকুমার বেশ গর্বের সঙ্গে বন্ধুকে খবর দিলো, “অনেক কোম্পানি আজকাল বেকার পঙ্গপালের ভয়ে কাগজে চাকরির বিজ্ঞাপন দেয় না। একটা কোম্পানি তো কেরানির পোস্টের জন্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে যা ফ্যাসাদে পড়েছে না! খবরের কাগজে বক্স নম্বর ছিল। সেখান থেকে তিন লরি অ্যাপ্লিকেশন কোম্পানির হেড আপিসে পাঠিয়েছে। এখনও চিঠি আসছে। তার ওপর আবার কীভাবে খবরের কাগজের আপিস থেকে বক্স নম্বর ফাঁস হয়েছে। কারা বিজ্ঞাপন দিয়েছিল তা কিছু লোক জানতে পেরেছে। প্রতিদিন তিন-চারশ লোক আপিসে ভিড় করছে। কোম্পানির, পার্সোনেল অফিসার তো ঘাবড়ে গিয়ে কলকাতা থেকে কেটেছেন।”