দাঁত দিয়ে ডান হাতের কড়ে আঙুলের নখ কাটলো সুকুমার। তারপর সোমনাথকে বললো, “তোর বাবা তো অনেকদিন আদালতে ছিলেন। একবার খোঁজ করিস তো, কী করে সিডিউল্ড-ট্রাইব হওয়া যায়।”
“আবার পাগলামী করছিস? তুই হচ্ছিস সুকুমার মিত্তির! মিত্তির কখনো সিডিউল্ড-ট্রাইব হতে পারে না। সোমনাথ বন্ধনকে বোঝাবার চেষ্টা করে।
সুকুমার বুঝলো না। বললো, “আমাকে হেল্প করবি না বল। চেষ্টা করে বিশ্বামিত্র যদি ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণে প্রমোটেড হতে পারে, তাহলে আমি কায়স্থ থেকে সিডিউল্ড-ট্রাইব হতে পারবো না কেন?’
“ওদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার কথা আমরা জানি না বলেই রসিকতা করতে পারছি। ওদের বড় কষ্ট রে,” সোমনাথ সরল মনে বললো।
সুকুমারও গম্ভীর হয়ে উঠলো। “তুই ভাবছিস আমি জাত তুলে ব্যঙ্গ করছি। চণ্ডালের পায়ের ধূলো জিভে চাটতে পর্যন্ত আমার আপত্তি নেই। কিন্তু জলাই মাসের মধ্যে আমাকে একটা চাকরি যোগাড় করতেই হবে।” বন্ধুর চোখ দুটো যে ছলছল করছে তা সোমনাথ বুঝতে পারলো।
একটু দঃখও হলো সোমনাথের। বন্ধুকে উৎসাহ দেবার জন্যে বললো, “জানিস সুকুমার, চাকরির কথা ভেবে ভেবে আমার মনটাও মাঝে মাঝে খারাপ হয়ে যায়। আধবুড়ো হয়ে গেলাম, এখনও একটা কিছু যোগাড় হলো না। কতদিন তার বাবার হোটেলের অন্ন ধ্বংসাবো? বউদি অত যত্ন করে ভাত বেড়ে দেন, দাদাদের যে-সাইজের মাছ দেন, আমার জন্যে তার থেকেও বড়টা তুলে রাখেন। জিজ্ঞেস করেন, আর কিছু নেবো কিনা। তবু তেতো লাগে।”
এবার রেগে উঠলো সুকুমার। “রাখ রাখ বড় বড় কথা। পাকা রুই মাছের টুকরো পাতে পড়লে বেশ মিষ্টি লাগে। ওই তেতো লাগার ব্যাপারটা তোর মানসিক বিলাসিতা। আমার কিন্তু আজকাল খেতে বসলে সত্যি তেতো লাগে। কাল রাত্রে ডাল পুড়ে গিয়েছিল। একে তো নিরামিষ মেনু তার ওপর ডাল পোড়া হলে কেমন মেজাজ হয় বল তো? মায়ের শরীর ভালো নয়, তাই বোন রাঁধছে ক’দিন। তা বোনকে বকতে গেলাম, বাড়িতে বসে বসে কী করিস? রান্নাটাও দেখতে পারিস না? বোন অমনি ছ্যাড়-ছ্যাড় করে শুনিয়ে দিলো। বলে কিনা, ‘তোমারও তো কাজকম্ম নেই বাড়িতে বসে ভাল রাঁধলেই পারো।’”
“তুই কী উত্তর দিলি?” সোমনাথ জানতে চায়।
“কিছু ্বললাম না, মুখ বুজে দাঁত খিঁচুনি হজম করলাম। তবে, সুকুমার মিত্তির একদিন এর প্রতিশোধ নেবে।”
প্রতিশোধের ব্যাপারটা সোমনাথের ভালো লাগে না। সে নির্বিবাদী মানুষ। বললো, “দূর। আপনজনদের ওপর প্রতিশোধ নিতে নেই।”
সুকুমার তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো, “টেবিল-চেয়ারে বসিয়ে বউদি তোকে মণ্ডা-মিঠাই খাওয়াচ্ছে, তাই তোর মাথায় প্রতিশোধের কথা ওঠে না। আমার পলিসি অন্য। যারা আমার সঙ্গে এখন যেরকম ব্যবহার করছে তা আমি নোট করে রাখছি। ভগবান যখন সময় দেবেন, তখন সুদসমেত ফিরিয়ে দেবো।”
“আঃ সুকুমার! হাজার হোক তোর নিজের বোন। তার ওপর আবার প্রতিশোধ কী? সোমনাথ আবার বন্ধুকে বোঝাবার চেষ্টা করলো।
হাসলো সুকুমার। “প্রতিশোধ মানে কি সমর্থ বোনকে ধরে মারবো, না রেগে গিয়ে দোজবরে বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দেবো? বোনের ব্যাপারে আমার প্রতিশোধের পলিসিই আলাদা। সব ঠিক করে রেখেছি এখন থেকে। চাকরিতে ঢুকে প্রথম মাসের মাইনে থেকে কণাকে একটা লাল রংয়ের ঝকঝকে শাড়ি কিনে দেবো। আর শাড়ির মধ্যেই একটা ছোট্ট চিরকুটে লেখা থাকবে—অমুক তারিখের রাত্রিতে যখন আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে বলেছিলি তখনই তোকে এই শাড়িটা দেবার ইচ্ছে হয়েছিল। ইতি–দাদা।”
সোমনাথ একমত হতে পারলো না। বললো, “এখন তোর রাগ রয়েছে, তাই এসব কথা ভাবছিস। যখন প্রথম মাইনে পাবি তখন দেখবি শুধু শাড়িটা দেবার ইচ্ছে হচ্ছে, চিঠির কথা মনেই পড়বে না। হাজার হোক ছোট বোন তো, তার মনে ব্যথা দিতে তোর মায়া হবে।”
সুকুমার কথা বাড়ালো না। বললো, “হয়তো তাই। কিন্তু মাইনে পাবার মতো অবস্থাটা কবে হবে বল তো?’
একটু থেমে সুকুমার বললো, “মাঝে মাঝে তো এম-এল-এ-দের কাছে যাই। রাগের মাথায় ওঁদের যা-তা বলি। আপনাদের জন্যেই তো আমাদের এই অবস্থা। চাকরি দেবার মুরোদ না থাকলে কেন ইংরেজ তাড়িয়েছিলেন, কেন নিজেরা গদি দখল করেছিলেন?”
“ওঁরা কী বলেন?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।
“মাইরি একটা আশ্চর্য গুণ, কিছুতেই রাগে না এই এম-এল-এ-গুলো। আমাকে ওইভাবে কেউ ফায়ার করলে, স্রেফ ঘাড় ধরে তাকে বাড়ির বাইরে বার করে দিতাম, বলতাম, পরের বারে ব্যাটাচ্ছেলে যাকে খুশী ভোট দিও।”
“যারা পাবলিককে সামলাতে পারে না তারা ভোটে হেরে যাবে” সোমনাথ বললো।
“ঠিক বলেছিস, অশেষ ধৈর্য লোকগুলোর, সুকুমার বিস্ময় প্রকাশ করলো। “অমন চ্যাটাং-চ্যাটাং করে শোনালাম, একটু রাগুলো না। বরং স্বীকার করে নিলো, প্রত্যেকটি ইয়ংম্যানকে চাকরি দেবার দায়িত্ব গভরমেন্টের। যে-সরকার তা পারে না, তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।”
“লজ্জা কিছু দেখলি?” সোমনাথ জানতে চায়।
“অত লক্ষ্য করিনি ভাই। তবে এম-এল-এ-দা ভিতরের খবরের অনেক ছাড়লেন। মাসকয়েকের মধ্যে অনেক চাকরি আসছে। সেলস ট্যাক্স, স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড, হাউসিং ডিপার্টমেন্টের হাজার হাজার চাকরি তৈরি হলো বলে। এতো চাকরি যে সে অনুপাতে গভরমেন্টের চেয়ার নেই। তা আমি বলে দিয়েছি সেজন্য চিন্তার কিছু নেই। চাকরি পেলে আমার বন্ধুর বাড়ি থেকে একটা চেয়ার চেয়ে নিয়ে যাবো। গভরমেন্টের অসুবিধা করবো না।”