সুকুমার মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললো, “তোর কোশ্চেনটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। দাঁড় একটু চিন্তা করে দেখি।”
দরে একটা পাঁচ নম্বর গড়িয়া-হাওড়া বাসে বাদড়-ঝোলা অবস্থায় সুকুমারের বাবাকে মুহূর্তের জন্যে দেখা গেলো। জন পঞ্চাশেক লোক হাঁই-হাঁই করে সেই দিকে ছুটে গেলেও বাস থামলো না, নিপুণভাবে আরও দু’খানা বাসকে পাশ কাটিয়ে মহরতের মধ্যে পালিয়ে গেলো। সুকুমার সেইদিকে তাকিয়ে বললো, “আমার বাবার কথাই ধর না। থার্ড ডিভিসনও নয়। রেড-আপ-টু, ম্যাট্রিক। অফিসে কেরানি হয়েছে তো?”
সোমনাথ বললো, “ও সব ইংরেজ আমলের ব্যাপার। তখন তো আমরা স্বাধীন হইনি।”
সুকুমার ছেলেটা সরল, একটু বোকাও বটে। সংসারের ঘাটে ঘাটে অনেক ধাক্কা খেয়েও একেবারে সিনিক হয়ে ওঠেনি। সে বললো, “তাহলে তো ইংরেজরাই ভালো ছিল। ননম্যাট্রিকও তাদের সময়ে অফিসে চাকরি পেতো—আর এখন হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বাড়িতে বসে রয়েছে।”
“তোর চাকরির জন্যে তাহলে ইংরেজকে ফিরিয়ে আনতে হয়, সোমনাথ টিপ্পনী কাটলো।
“আমি ভাই তোকে ফ্র্যাঙ্কলি বলছি—সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা এসব কিছুই বুঝতে চাই না। যে আমাকে চাকরি দেবে, আমি তার দলে—সে মহম্মদ আলী জিন্নাহ, মাও-সে-তুং হলেও আমার আপত্তি নেই।”
“আস্তে! আস্তে!” সুকুমারকে সাবধান করে দিলো সোমনাথ। “কেউ শুনলে বিপদ হবে। পাকিস্তানের স্পাই বলে চালান করে দেবে।”
বেজায় রেগে উঠলো সুকুমার। “মগের মুলুক নাকি! চালান করলেই হলো? অ্যারেস্ট করলে জেলের মধ্যে বসিয়ে রোজ খিচুড়ি, আলচচ্চড়ি খাওয়াতে হবে। তার থেকে একখানা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়ে সমস্যা সমাধান করে ফেললা না বাবা! চাকরি পেলে তোমাদের কোনো হাঙ্গামা থাকবে না। তখন জিন্নাহ, নিক্সন, মাও-সে-তুং, রানী এলিজাবেথ কারও নাম মুখে আনবো না—একেবারে সেন্ট পারসেন্ট স্বদেশী বনে যাব। একদম দিল হ্যায় হিন্দস্থানী!”
“সি-আই-ডি কিংবা আই-বি’র লোকেরা যদি এসব শোনে, কোনোদিন তোর সরকারী চাকরি হবে না। জানিস তো, আপয়েন্টমেন্ট লেটার ইস্যু করবার আগে পুলিশে খোঁজখবর হয়—দুজন গেজেটেড অফিসারের চরিত্র-সার্টিফিকেট লাগে।” সোমনাথের বকুনিতে সুকুমার এবার ভয় পেয়ে গেলো।
বললো, “যা বলেছিস, মাইরি। হাটের মধ্যে দাঁড়িয়ে রাজনীতির গোবর ঘেটে লাভ নেই। বহু ছেলে তো ওই করে ড়ুবেছে। তারা পলিটিকস করেছে, দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার মেরেছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পার্টি ফান্ডের জন্যে চাঁদা আদায় করেছে, ঝান্ডা তুলেছে, মিছিলে যোগ দিয়েছে, স্লোগান তুলেছে, মনুমেন্টের তলায় নেতাদের বক্তৃতা শুনেছে—ভেবেছে এই সব করলেই সহজে চাকরি পাওয়া যাবে। এখন অনেক বাছাধন ভুল বুঝতে পেরে আঙুল চুষছে।”
সোমনাথ গম্ভীর হয়ে বললো, “এক-এক সময়ে মনে হয়, একেবারে কিছু না করা থেকে যা হয় কিছু করা ভালো। তাতে ভুল হলেও কিছু আসে যায় না।”
সুকুমার তেড়ে উঠলো। “তিন মাস পরে যাদের পেটে ভাত থাকবে না তাদের এসব কথা মানায় না। আমাদের দলে টেনে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে কত ছেলেধরা যাদবপরে ঘোরাঘুরি করছে তাদের পকেটে কত রকমের পতাকা। কোনোটা একরঙা, কোনোটা তিনরঙা। তার ওপর আবার কত রকমের ছাপ! আমি ওসব ফাঁদে পা দিই না বলে, ছেলেধরাদের কী রাগ আমার ওপর। আমার সোজা উত্তর, আমার বাবার তিনমাস চাকরি আছে, আমার পাঁচটা নাবালক ভাইবোন। দেশোদ্ধার করবার মতো সময় নেই আমার।”
অফিস টাইমের যাত্রীদের দিকে সুকুমার আবার তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, “যে যা করছে করুক, আমার কী?”
কয়েক মিনিট ধরে সুকুমার নিজের মনে কী সব ভাবলো। তারপর সোমনাথের পিঠে আঙুলের খোঁচা দিয়ে আবার আরম্ভ করলো, “তুই যা বলছিলি—এই যে পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে লোক অফিসের খামে মোড়া টিফিন কৌটো হাতে হাজরি দিতে চলেছে, এরা সবাই তো ইংরেজ আমলে চাকরিতে ঢোকেনি। ওই ছোকরাকে দেখ না—ইংরেজ রাজত্বে তো ওর জন্মই হয়নি। অথচ অফিসে বেরুচ্ছে।”
সুকুমার এবার এক কেলেঙ্কারি করে বসলো। নিখুঁত ইস্ত্রি করা শার্ট ও প্যান্ট পরে এক ছোকরা বাসে উঠছিল, ঠিক সেই সময় ছুটে গিয়ে সুকুমার তাকে জিজ্ঞেস করলো, “দাদা, আপনি ফার্স্ট ডিভিসনে পাস করেছিলেন?”
অতর্কিত প্রশ্নে ভদ্রলোক চমকে উঠেছিলেন। ব্যাপারটা ঠিকমতো মাথায় ঢোকবার আগেই বাস ছেড়ে দিলো। বিরক্ত ভদ্রলোক চলন্ত গাড়ি থেকে সুকুমারের দিকে অগ্নিদটি বর্ষণ করলেন—তার রসিকতার অর্থ বুঝতে পারলেন না।
সুকুমার বোকার মতো ফুটপাথে ফিরে এলো। বললো, “আমি ভাই রসিকতা করিনি। ওঁর পিছনেও লাগিনি–স্রেফ জানতে চাইতাম কী করে চাকরিটা যোগাড় করলেন।”
সোমনাথ বললো, “ওরকম করিস না সুকুমার। কোন দিন বিপদে পড়ে যাবি। ভদ্রলোক হয়তো পড়াশোনায় আমাদের মতো। তাহলে রেগে যেতে পারতেন।”
সুকুমার ক্ষমা চাইলো। তারপর কী ভেবে ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো, “সোম, তুই ঠিক বলেছিস। ওইভাবে জ্বালাতন করাটা আমার উচিত হয়নি। ভদ্রলোক যদি আমাদের মতো সেকেন্ড কিংবা থার্ড ডিভিসনের মাল হয়েও চাকরি পেয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয় সিডিউল্ড কাস্ট।”
“ভাতে কী এসে যায়?” বিরক্ত সোমনাথ প্রশ্ন করলো।
“খুবই এসে যায়। সিডিউল্ড কাস্টরাও এখন চাকরি পাচ্ছে না। ভদ্রলোক সিডিউল্ড-ট্রাইব হতে পারেন। চাকরির বিজ্ঞাপনে প্রায়ই লেখে তপসিলীভুক্ত উপজাতি হলে অগ্রাধিকার পাবে। ইন্ডিয়াতে সিডিউল্ড-ট্রাইব গ্রাজুয়েট বোধ হয় কেউ বসে নেই।”