দুজনে ঠিকানা বিনিময় করেছিল। কয়েকদিন পরেই সুকুমার যোধপুর পার্কের বাড়িতে সোমনাথের খোঁজ করতে এসেছিল। সোমনাথের সাজানো-গোছানো বাড়ি দেখে সুকুমার খুব আনন্দ পেয়েছিল। কথায় কথায় সুকুমার একদিন বলেছিল, “আমাদের মাত্র দেড়খানা ঘর। বসতে দেবার একখানা চেয়ারও নেই। চাকরি-বাকরি হলেই ওসব দিকে একটু নজর দিতে হবে। দুটো চেয়ার, একটা টেবিল, জানালার পর্দা—কিনতেই হবে। আমার বোন পর্দার রং পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছে, কোন দোকান থেকে কিনবে তাও ঠিক, শুধু আমার চাকরি হবার অপেক্ষা।”
ওদের বাড়িতে যাবার মতলব করেছে সোমনাথ। কিন্তু সুকুমার উৎসাহ দেয় নি। সোজাসুজি বলেছে, “চাকরিটা হোক, তারপর একদিন তোকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবো। এখন যা বাড়ির মেজাজ, তোকে নিজে থেকে এক কাপ চা পর্যন্ত দেবে না। ঘরের মধ্যে বসাতে পারবো না, বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলতে হবে।”
সুকুমার বিব্রত হবে ভেবেই সোমনাথ ওদের বাড়িতে যাবার প্রস্তাব তোলে নি। কিন্তু দুই বন্ধুতে প্রায় দেখা হয়েছে। যোধপর পাক থেকে গল্প করতে করতে ওরা কখনও সেলিমপরের মোড়ে চলে গেছে। দুজনে সমব্যথী, সুখ-দুঃখের কত কথা হয় নিজেদের মধ্যে।
আজও সুকুমার বললো, “বাড়িতে বসে থেকে কী করবি? চল, একটু ঘরে আসি।”
বাড়ি থেকে বেরোবার, সুযোগ পেয়ে সোমনাথ রাজী হয়ে গেলো। ট্রাউজারের ওপর একটা বুশ শার্ট গলিয়ে নিয়ে সুকুমারের সঙ্গে সে পথে বেরিয়ে পড়লো।
রাস্তায় সকালের জনপ্রবাহ দেখে সোমনাথ নিজের দুঃখের কথা ভাবে। পৃথিবীটা যে কত নিষ্করুণ তা সে বোধহয় এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। বাড়িতে দাদা বউদি বাবা সবাই এতো ভালোবাসেন—এতে তার প্রতিপত্তি—কিন্তু বাড়ির বাইরে এই জন-অরণ্যে তার কোনো দাম নেই। অন্যের সঙ্গে লড়াই করে একটা সামান্য দশটা-পাঁচটার চাকরি পর্যন্ত সে যোগাড় করতে পারছে না।
সুকুমার জিজ্ঞেস করলো, “কী হলো তোর? গম্ভীর হয়ে গেলি কেন?”
সোমনাথ বললো, “ভাবছি, বাড়ির ভিতরের সঙ্গে বাড়ির বাইরের কত তফাৎ।”
“মারো গুলি! কবিতা ছাড়,” সুকুমার এবার বকুনি লাগালো। “তুই ভাগ্যবান। বেশির ভাগ লোকের ভেতর-বাইরে দুই-ই কেরোসিন। আমার অবস্থা দেখ না। জুলাই মাস থেকে বাবার চাকরি থাকবে না। বাড়ির বড় ছেলে, অথচ সংসারে কোনো প্রেস্টিজ নেই।”
“কেন?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করে।
“চাকরি থাকলে প্রেস্টিজ হতো। এখন বাবা মা ভাই বোন সবাই বলে, গুড ফর নাথিং। অনেক ইয়ংম্যান নাকি এই বাজারেও চাকরি ম্যানেজ করেছে। শুধু আমি পারছি না। বাবা মাঝে মাঝে বলেন, ‘ভস্মে ঘি ঢেলেছি, সুকুমারকে বি-এ পড়িয়ে কী ভুলই যে করেছি।’ বিদ্যে না থাকলে আমি নাকি কারও বাড়িতে চাকর-বাকর হয়ে নিজের পেটটা অন্তত চালাতে পারতাম।”
সোমনাথ কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ গড়িয়াহাটের দিকে হাঁটতে লাগলো। বাঁ হাতের আঙুল মটকিয়ে সুকুমার বললো, “আমিও কী ভুল যে করেছি! মা কালীকে পুজো দিয়ে ইস্কুল ফাইনালে যদি ফার্স্ট ডিভিসন বাগাতে পারতাম, তাহলে এতোদিন চাকরি কাকে বলে দেখিয়ে দিতাম।”
সোমনাথ বললো, “শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছিস কেন? তোর আমার সেকেন্ড ডিভিসন কাঁচিয়ে তো আর ফার্স্ট ডিভিসন করা যাবে না!”
সুকুমার বললে, “বড় দুঃখ লাগছে মাইরি। ব্রেবোর্ন রোডের একটা ব্যাঙ্কে স্কুল ফাইনালে ফার্স্ট ডিভিসন হলে কেরানির চাকরি দিচ্ছে—মিনিমাম ৬৪% নম্বর দেখাতে হবে।”
সোমনাথ আপসোস করলো না। সে আজকাল অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে। বললো, “ওটাও এক ধরনের চালাকি।”
সুকুমার বললো, “চালাকি বললেই হলো। ব্যাঙ্কের নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দিয়েছে।”
“যে-ছেলে স্কুল ফাইনালে শতকরা ৬৪ নম্বর পেয়েছে, সে কোন দুঃখে লেখাপড়া কুলঙ্গিতে রেখে ব্যাঙ্কে ঢুকতে যাবে?” সোমনাথ বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে জানতে চাইলো।
“এ-পয়েন্টটা আমার মাথায় আসেনি। সাধে কি আর বাবা বলেন, আমার মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছু নেই!” সুকুমারের মুখটা মলিন হয়ে উঠলো।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা গোলপার্কের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সকালবেলার অফিস টাইম। অনেকগুলো প্রাইভেট মোটর গাড়ি হস-হস করে বেরিয়ে গেলো। বাসে, ট্যাক্সিতে, মিনিবাসে তিল ধারণের জায়গা নেই। সুকুমার হাঁ করে ওই ব্যস্ত জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বললো, “না ভাই আর তাকাবো না। শেষ পর্যন্ত কারও চাকরিতে শনির দৃষ্টি লেগে যাবে। মনকে যতই শাসন করবার চেষ্টা করছি, বেটা ততই পরের চাকরিতে নজর দিচ্ছে। লোভের মাল ফেলতে-ফেলতে ভাবছে—এতো লোকের চাকরি আছে অথচ সুকুমার মিত্তির কেন বেকার?”
সোমনাথ বললো, “যত লোককে অফিস যেতে দেখছি, এরা প্রত্যেকে ফার্স্ট ডিভিসনে স্কুল ফাইনাল পাস করেছে বলছিস?” সুকুমার বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলো। মাথা চুলকে বললো, “খুব ডিফিকাল্ট কোশ্চেন করেছিস। তোর বেশ মাথা আছে। হাজার হোক ছোটবেলায় দুধ-ঘি খেয়েছিস। তুই কেন পড়াশোনায় সোনার চাঁদ হলি না, বল তো?”
মন্দ বলেনি সুকুমার। পড়াশোনায় দাদাদের মতো ভালো হলে, সত্যিই সোমনাথের দুঃখের কিছু থাকতো না। নিজের মনের কথা সোমনাথ কিন্তু প্রকাশ করলো না। সুকুমারের যা স্বভাব, হয়তো কমলা বউদিকেই একদিন সব কথা বলে বসবে। সোমনাথ তাই পুরোনো প্রসঙ্গ তুলে বললো, “শক্ত শক্ত কোশ্চেন অনেক মাথায় আসে, কিন্তু উত্তর খুঁজে পাই না।”