সুশান অবশ্য একবার চিঠি দিয়েছিল। জানিয়েছিল, আর একটা ভালো গাড়ি কিনেছে সে। এবং যে কাজের জন্য মার্কো এত উদ্বিগ্ন আছে, তাও এগুচ্ছে। তবে অ্যাটর্নি কিছু টাকা চেয়েছে।
ধার করে মার্কো সুশানের ঠিকানায় কিছু টাকাও পাঠিয়েছিলেন। তারপরেই বিপদটা ঘটল।
তাঁকে হঠাৎ পুলিসে ধরল। ওঁর ইটালিয়ান গন্ধ এতদিন পরে হঠাৎ কর্তৃপক্ষকে আবার সচেতন করে তুলল। আর ইটালির সঙ্গে মিত্রপক্ষের তখন কী রকম সম্পর্ক সে তো জানোই।
যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছিল মার্কোপোলোকে। জীবনে ধিক্কার জন্মে গিয়েছিল। ছাড়া পেয়ে সোজা ফিরে গিয়েছেন ইটালিতে। অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো মানসিক অবস্থা মার্কোর তখন ছিল। রিভিয়েরায় ছোটখাট কাজ করে কোনোরকমে জীবনধারণ করছিলেন।
তারপর হঠাৎ একদিন মনে পড়ল জীবনের হিসেব-নিকেশে কোথায় যেন একটা বড় ভুল জট পাকিয়ে রয়েছে। লেজারের একটা মোটা অঙ্ক মধ্যপ্রাচ্যে এক অভিশপ্ত নগরীতে সাসপেন্স অ্যাকাউন্টে পড়ে রয়েছে। জীবন সম্বন্ধে প্রবল অভিযোগে মার্কোপোলোর নিঃসঙ্গ অন্তর যেন দপ করে জ্বলে উঠল।
চাকরির চেষ্টা আরম্ভ করলেন, প্রথমে রেঙ্গুনের একটা হোটেলে। লোকের অভাব, ওরা অনেক টাকা মাইনেতে তাকে নিয়ে গেল। কিন্তু রেঙ্গুনে থাকবার জন্য তিনি তো ইটালিয়ান রিভিয়েরা ছেড়ে আসেননি। ওখানে কিছুদিন চাকরি করে, আবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
এবার কেন্দ্র কলকাতা। শাজাহান হোটেলের ম্যানেজারের চাকরি খালি ছিল। মালিকরা তাঁর মতো লোক পেয়ে আদর করে নিয়েছেন।
কিন্তু কোথায় সুশান? কোথায় সেই ডাইভোর্স মামলা?
কলকাতার বিশাল জনারণ্যে যুদ্ধের সময় হঠাৎ জ্বলে-ওঠা একটা মেয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। অ্যাটর্নি আপিসে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন। ওরা কিছু বলতে রাজি হয়নি। পুরনো অ্যাটর্নি নিজের শেয়ার পার্টনারকে বিক্রি করে দিয়ে, ব্রহ্মাণ্ডের বৃহত্তম পার্টনারের সঙ্গে হাত মেলাবার জন্য জীবনের ওপারে চলে গিয়েছেন।
কোর্টে খোঁজ নিয়েছিলেন। এই নামে কোনো ডাইভোর্স অর্ডার হয়নি। বায়রন এবার থামলেন।
তারপর? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
তারপরই আমার ডাক পড়েছে। চেষ্টা করছি। বায়রন বললেন।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত্রি অনেক হয়েছে। এবার যাওয়া দরকার।
বায়রন বললেন, মার্কোপোলোকে অধৈর্য হতে বারণ করো। খুব শিগগিরই যা হয় একটা হয়ে যাবে।
বিদায় নেবার আগে বায়রন বললেন, সায়েবের সঙ্গে থেকে থেকে তোমার তো অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছে। তোমার সাহায্য নিতে হবে আমাকে।
আপনি চাকরি দিয়েছেন, আর সামান্য সাহায্য চাইতে দ্বিধা করছেন?
পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরে, বায়রন বললেন, ছি ভাই, ওসব কথা বলতে আছে?
সেই রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক ভেবেছিলাম। চেষ্টা করেও চোখে ঘুম আনতে পারছিলাম না। সুশান বা লিজাকে আমি দেখিনি, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই ওদের দুটো কাল্পনিক মূর্তি চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
সুশান এখন কোথায় কে জানে? সে কি এই শহরের কোনো অখ্যাত পল্লির অন্ধকার ঘরে কষ্টের দিনগুলো কোনোরকমে কাটিয়ে দিচ্ছে? কিংবা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে, বাড়ি কিনে, রেস্তোরাঁ এবং সংগীতকে জীবন থেকে চিরতরে বিদায় দিয়ে, অবসরের আনন্দ উপভোগ করছে?
থিয়েটার রোডের সেই বাড়িতে সুশান নিশ্চয়ই আজ নেই। থাকলে বায়রন সায়েব অনেকদিন আগেই তাকে খুঁজে বার করে, মার্কোপোলোর সমস্যা সমাধান করে দিতেন। নিজের দাম্পত্যজীবনের সমস্যা না মিটিয়ে, সে আজ কোথায় পড়ে রইল? তার কি একবারও মনে পড়ে না, বিদেশি মার্কোপোলো একদিন তার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন এবং আরও অনেক কিছু বিসর্জন দেবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন?
মার্কোপোলোর বেদনাময় দাম্পত্যজীবনের জন্য প্রকৃত দুঃখ অনুভব করেছি। কিন্তু আবার অন্যদিকটাও বিচার করে দেখবার চেষ্টা করেছি। ভেবেছি, কী আশ্চর্য এই পৃথিবী! বেঁচে থাকার সমস্যা সমাধান করতে করতেই কত নিস্পাপ লোকের সমগ্র সামর্থ্য ব্যয়িত হচ্ছে; আর যাদের অন্নচিন্তা নেই, একঘেয়ে সুখে ক্লান্ত হয়ে তারা শখের সমস্যা তৈরি করছে। আবার ভেবেছি, কাউকে দোষ দেবার অধিকারই আমার নেই। জীবনে সমস্যা সৃষ্টি না-হলে বাঁচার আনন্দের অর্ধেকই হয়তো নষ্ট হত। দুঃখ আছে, দুশ্চিন্তা আছে, দৈন্য আছে বলেই তো জীবন এখনও জোলো এবং একঘেয়ে হয়ে ওঠেনি। সংসারের সুখের ইতিহাসে আমরা কেউই আগ্রহী নই। জগতের ইতিহাসে মানুষের পরম পূজ্যগণ সকলেই তো দুঃখের অবতার, তাদের কেউই আরামে লালিত লক্ষ্মীর ক্রীতদাস নন।
ভোরবেলায় যখন হোটেলে হাজির হয়েছি, গত রাত্রের চিন্তাগুলো তখনও মনের মধ্যে থেকে সম্পূর্ণ বিদায় নেয়নি। পার্থক্যটা তাই আশ্চর্য লাগল। এই তো কয়েক মুহূর্ত আগে আমি যেখানে ছিলাম তার চারিদিকে বস্তি; কঁচা নর্দমা, ডাস্টবিন। আর এখানে? ময়লা তো এখানেও সৃষ্টি হয়, কিন্তু সেগুলো যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায় বুঝি না। যা কিছু অশোভন, যা কিছু দৃষ্টিকটু তাকেই চোখের সামনে থেকে আড়ালে সরিয়ে রাখার শিল্পটি এরা আশ্চর্যভাবে আয়ত্ত করেছে।
এই প্রতিমুহূর্তে সুন্দর হয়ে থাকার পিছনে যে কি পরিমাণ পরিশ্রম আছে, তা শাজাহান হোটেলে ভোরবেলায় গেলে কিছুটা বোঝা যায়।
কলের ঝাঁটা দিয়ে (ভ্যাকুয়াম ক্লিনার) দিনের লাউঞ্জের কার্পেট পরিষ্কার করা হচ্ছে। অত সকালেই কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ক্লান্ত জমাদারগুলো মেঝেতে বসে যখন এক মনে মেঝে ঘসে যাচ্ছে তখন আমাদের এই কলকাতা শহরে প্রায় কেউই ঘুম থেকে ওঠেনি।