সরাবজি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, দেখলেন তো? আগে একলা ছিলাম, তখন সব সহ্য হত। এখন বয়স হচ্ছে, মেয়ের বাবা হয়েছি, কেমন যেন অসহ্য লাগে।
আমি কিছুই না বলে ফিরে এসেছি। খবর পেয়েছি, সরাবজির দোকান এখন ভালোভাবেই চলছে। অনেক মদের স্টক ওর। যা অন্য জায়গায় পাওয়া যায় না তাও ন্যায্যমূল্যে সরাবজির বার-এ পাওয়া যায়। সরাবজি বলেছে, ঈশ্বর ওপরে আছেন, সৎপথে থেকে ব্যবসা করছি। তিনি দেখবেন।
আরও একদিন সবজির সঙ্গে দেখা হয়েছে। ভদ্রলোক মুখ শুকনো করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি গাড়িতে যাচ্ছিলাম। গাড়ি থামিয়ে বললাম, কী ব্যাপার?
সরাবজি বললে, ড্রিঙ্ক করলে মানুষের বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায় কেন বলতে পারেন?
বললাম, হয়তো অ্যালকহলের রাসায়নিক ফল।
সরাবজি বললে, আমি কান মলেছি! মাতালদের আমি কোনোদিন আর কিছু বলব না। জানেন, দোকানে আসবে এক সঙ্গে; এক সঙ্গে মদ খাবে, এক সঙ্গে মস্করা করবে, তারপর এক সঙ্গে ঝগড়া বাধাবে। সেদিন রাত নটার সময় দু ভদ্রলোক নেশার ঘোরে চিৎকার করছিলেন। টেবিলে গেলাস বাজাচ্ছিলেন। গান গাইছিলেন। আর একদল লোক—এঁরা আমার দোকানের লক্ষ্মী, রোজ তিন চারশ টাকার মদ নেন,তারাও পাশে বসেছিলেন। তাদের একজন আমার কাছে এসে বললেন, আপনার বার যে তাড়িখানা হয়ে গেল। ভদ্রলোকরা এখানে আর ড্রিঙ্ক করতে আসবেন না। হাফেসজির মেয়েরা বারের লোকগুলোকে আপনি গ্রশ্রয় দিচ্ছেন। ওদের সামলান, না হলে আমরা আর আসব না।
বাধ্য হয়ে আমি গিয়ে ভদ্রলোক দুজনের কাছে দাঁড়ালাম। তারা দুজনে তখন রেডিওতে ক্রিকেট খেলার রিলে করছেন। ইন্ডিয়া এক ওভারে এম সি সি-কে খতম করে, পরের ওভারে অস্ট্রেলিয়াকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে। এক ভদ্রলোক বলছেন, তা হয় না। আর এক ভদ্রলোক বলছেন, আমার যা খুশি তাই করব। তাতে কার পিতৃদেবের কী? এবার অকথ্য গালাগালির বর্ষণ। আমি বললাম, আপনারা এ কী করছেন?
ওরা বললে, বেশ করছি। তুমি কে হে হরিদাস পাল?
আমি বাধ্য হয়েই বললাম, এ-রকম হই-চই এই বারে চলতে পারে না, এতে অন্য কাস্টমারদের অসুবিধে হয়।
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে উঠলেন। অন্য লোকদের ডেকে বললেন, জানেন, মাতাল হয়েছি বলে বের করে দেবে বলছে। বারের মালিক-এর এত বড় স্পর্ধা।
অন্য কয়েকজন ওঁদের দলে গিয়ে, চিৎকার করে বললেন, মালিকের এত সাহস! ব্রাদার, আমরা এখনি সবাই এখান থেকে বেরিয়ে যাব। মদ খেয়ে হই হই করবে না তো কি গীতা পড়ে শোনাবে?
সরাবজির চোখ এবার ছলছল করে উঠল। সবচেয়ে আশ্চর্য কি জানেন? যারা আমার কাছে কমপ্লেন করেছিল, তারাও টেবিল ওয়াক-আউট করে গেল। আমি তাদের হাত ধরে বললাম, আপনারা বললেন বলেই, আমি ভদ্রলোককে বারণ করতে গেলাম। ওরা কী বললে জানেন?
বললে, আমরা মাতাল মানুষ, নেশার ঘোরে যদি কিছু বলেই থাকি, তা বলে আপনি একজন ভাইকে অপমান করবেন? হু আর ইউ? কলকাতায় কি আর মালের দোকান নেই? এই দোকানে ঘুঘু চরবে। আমরা এখানে প্রয়োজন হলে পিকেটিং করব।
সরাবজি বললে, প্রায় তিন সপ্তাহ আমার হোটেল বন্ধ, কেউ আসে না। শেষে বাধ্য হয়ে আজ এক ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়েছিলাম।বহু কষ্ট করে তার ঠিকাটা জোগাড় করেছি। হাতজোড় করে তার কাছে ক্ষমা চাইলাম। বললাম, যদি আমার কোনো দোষ হয়ে থাকে আমি ক্ষমা চাইছি। তবে আপনারাই আমাকে বলতে বলেছিলেন, তাইভদ্রলোককেআমি গোলমাল করতে বারণ করেছিলাম। ভদ্রলোক রাজি হয়েছেন। আবার দলবল নিয়ে আসবেন। কিন্তু ভদ্রলোক সাবধান করে দিয়েছেন, মাতালদের কথায় বিশ্বাস করে আর কখনও কাউকে অপমান করবেন না।
হবস এবার বর্তমানে ফিরে এলেন। বললেন, এই সবজিকেই আমি চিনতাম। বেশ গুছিয়ে এবং ভদ্রভাবে ব্যবসা করছিল। একটিমাত্র মেয়ে, তাকেও বাইরে ইস্কুলে রেখে পড়িয়েছে। তার মেয়েকেও আমি দেখেছি। চিড়িয়াখানাতে আলাপ হয়েছিল, মেয়েকে সঙ্গে করে বাবা গিয়েছিলেন। এই পর্যন্তই জানতাম। কিন্তু সরাবজি কী করে ধর্মতলা থেকে শাজাহানে হাজির হল, জানি না।
হবস এবার নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। বললেন, তোমাদের ম্যানেজার মনে হচ্ছে আজ আর ফিরবে না! ব্যাপার কী? হোটেল ছেড়ে প্রায়ই আজকাল বেরিয়ে যাচ্ছেন। একা স্যাটা বোস কি এই হোটেল চালাবে?
হবস উঠে পড়লেন। যাবার আগে বললেন, যাক, সরাবজির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, এটাই আনন্দের কথা।
আবার যখন ডিউটিতে ফিরে গিয়েছি, সরাবজির সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার টিকলো নাক এবং প্রশস্ত বুকও যেন ঈশ্বরের চরণে বিনয়ে নত হয়ে রয়েছে। কম কথা বলেন তিনি। তবুও আজ তাকে আমার বহুদিনের পরিচিত মনে হল। শাজাহনের বার ম্যানেজারের মধ্যে আর-একজন আমিকে খুঁজে পেলাম। আমারই মতো নিজের পায়ে হাঁটা পথেই তিনি সংসারের সুদীর্ঘ সমস্যা অতিক্রম করে এসেছেন।
হেড বারম্যান বলেছে, জব্বর সায়েব বাবু, সব ককটেল হাতের মুঠোর মধ্যে। কতরকমের মিক্সিং যে জানেন।
আমরা দাঁড়িয়ে দেখেছি বার-এ তিল ধারণের জায়গা নেই। বিজনেসের যন্ত্রপাতিতেও তেল দরকার হয়, সেই আধুনিক লুব্রিকেশন তেল হল হুইস্কি। ঝুঁদ হয়ে চোখ বুজে উপস্থিত ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহিলারা গলায় হুইস্কি ঢেলে দিচ্ছেন, খালি গেলাস আবার বোঝাই হচ্ছে। স্বল্পভাষী সরাবজি আমাকে বললেন, মৃতদেহ টিকিয়ে রাখতে হুইস্কির মতো জিনিস নেই। যদি কোনো মৃতদেহ সংরক্ষণ করতে চাও তবে তাকে হুইস্কির মধ্যে রাখো—আর জ্যান্ত লোককে যদি মারতে চাও তাহলে তার মধ্যে হুইস্কি ঢাললা!