সেখানে যারা ছিল সব্বাই হাসতে লাগল। বড়োকাকিমা রেগেই ছিলেন, চেঁচিয়ে বললেন, তা অত হাসবার কী আছে এতে? পারব না নাকি শ্রীকৃষ্ণ সাজতে তোরা ভেবেছিস! জানিস, ইস্কুলের প্রাইজে আমি আওরঙ্গজেব সেজেছিলাম?ইয়া গোপ এঁকে দিয়েছিল, সে আর কিছুতেই ওঠে না। সে যাক গে, কিন্তু তুই শ্রীকৃষ্ণ সাজিস না কেন রে বিভু?
বিভুদা আমতা আমতা করতে লাগল।
–ইয়ে– না– মানে– আমি দ্বিতীয় পাণ্ডব সাজছি কি না–
–আহা, ভারি তো দ্বিতীয় পাণ্ডব সাজছিস, তিন লাইন তো কথা বলতে হবে। ও পার্টটা চাঁদকে দিয়ে, তুই শ্রীকৃষ্ণ সাজলেই পারিস। তুই যখন হলি, দেশ থেকে আমার ধাই-মা তোকে দেখতে এসেছিল। চেয়ে চেয়ে আর চোখ ফেরাতে পারে না। বললে, আহা, ঠিক যেন নীল পদ্মের কুঁড়ি, তেমনি রং, তেমনি ঢং, মানুষ বলে তো মনে হয় না গো! শ্রীকৃষ্ণ তোকেই মানাবে।
বিভুদা ঢোক গিলে বললে, না, মানে, আমি একটু মানে শ্রীকৃষ্ণ বেশ রোগা ছিলেন কিনা– তা ছাড়া চাঁদের পেটে বালিশ বেঁধে দিলেও ওকে ভীমের মতো দেখাবে না। কী লিকপিকে হাত-পাগুলো দেখেছ! গোলমরিচ খেলে হেঁচকি ওঠে!
বলে বড়োকাকিমার সামনে আমার হাতের গুলি সেইরকম করে টেনে দড়কচা বানিয়ে দিল। আমার ভীষণ রাগ হল, বড়োকাকিমার ওপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, আহা! তুমি তো কুকুর ভয় পাও; পাণ্ডবদের সঙ্গে যে কুকুরটা স্বর্গে গিয়েছিল, তাকে দেখলে তো তুমি ভয়ে পালিয়ে যেতে! আর আমার বন্ধু বিশের মস্ত পোড়া হাঁড়ির মতো মুখওয়ালা কুকুর সিংহকে দেখলে তো তোমার পতন ও মুচ্ছো হয়ে যাবে! তোমার চোখ উলটে যাবে।
আমার সাহস দেখে দারুণ অবাক হয়ে বিভুদার মুখে আর কথা সরে না! তারপর বললে, বিশে? দেখলে মা, এত বারণ করা সত্ত্বেও পাড়ার বখা ছেলেদের সঙ্গে ভাব করেছে! এবার খারাপ কথা বলতে আর বিড়ি ফুঁকতে শিখতে কদ্দিন! জ্যাঠামশাই শুনলে কী বলবেন বলো তো, তোমাদেরই দোষ দেবেন দেখো!
অমনি বড়োকাকিমা চোখ গোল গোল করে খপ করে আমার কাধ ধরে ফেললেন, কোথায় পালাতে চেষ্টা করছিস, চাঁদ? বিভু যা বলল সেসব কি সত্যি? কে ওই বিশেটা? নাম শুনেই মনে হয় একটা গুন্ডা পালোয়ান কেউ। কোথায় ওর সঙ্গে তোর দেখা হল বল শিগগির। পাড়ার যত সব বয়ে-যাওয়া বাজে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা! বিশে নিশ্চয় ফণী মিত্তিরদের বাড়ির কেউ?
আমি তো পালাবার পথ পাই নে। রাগের মাথায় বিশের নাম করে ফেলাটা যে কত বড়ো অন্যায় হয়ে গেছে বুঝতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু থামতে পাচ্ছিলাম না। বিভুদাদের কথায় গা জ্বলে যাচ্ছিল। এদিকে বিভুদাও বার বার বলছে, বল, কে ওই বিশে! ওই ভোঁদাদের দলের কেউ নাকি? ওঃ! তাহলে এবার বোঝা গেল ভোঁদারা আমাদের ভেতরকার সব খবর কোত্থেকে পায়! বিশ্বাসঘাতক! স্পাই! গুপ্তচর! টিকটিকি!
শেষটা আমি রেগে চেঁচিয়ে বললাম, না, না, না, না, বিশে তোমাদের পাড়ার কেউ নয়। এ পাড়ার কেউ ওকে চেনেও না, ও মোটেই বখাটে বয়ে-যাওয়া স্পাইনয়। তবে ওর গায়ে ভীষণ জোর, বিভুদাকে ও এক হাতে পটকে দিতে পারে, ও কাউকে ভয় পায় না, ও ও
বড়োকাকিমা বললেন, আহা! ওরকম কচ্ছিস কেন চাঁদ? ওর সঙ্গে তোর কোথায় দেখা হল? তোর বাবা-মা তোকে আজেবাজে কারো সঙ্গে মিশতে দেন না বলেই বলছি।
আমি আবার চেঁচাতে লাগলাম, মোটেই বিশে আজেবাজে লোক নয়! বিশে কী ভালো! হাঙরমুখো নৌকো চেপে কুকুর নিয়ে আসে!
–কোথায় আসে?
পেরিস্তানে।
কাকিমা আর বিভুদা তো হাঁ! পেরিস্তানে? পেরিস্তান আবার কোন জায়গা।
-হ্যাঁরে, তোর শরীর খারাপ লাগছে না তো রে! গত বছরের আগের বছর যে-রকম ম্যালেরিয়াতে ভুগলি, শরীরটাতে সেই ইস্তক আর কিছু নেই!
আমি বললাম, না, বিশে বলেছে খুব ভালো আমার শরীর, ওসব যত রাজ্যের বাজে বানানো কথা! কিছু হয়নি আমার! পুতুপুতু করা ভারি খারাপ!ও-রকম করলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব বলে রাখলাম!
এই বলে ফস করে বড়োকাকিমার হাত থেকে গলে বেরিয়ে, একেবারে নিজের ঘরে দরজা দড়াম ও ছিটকিনি! কারো কথায় দরজা খুলিনি, গোঁজ হয়ে অনেক বেলা অবধি ঘরে বসে থাকলাম। তারপরে যে-যার নিজের কাজে চলে গেলে, বাইরেটা চুপচাপ হয়ে গেলে, গুটিগুটি বেরিয়ে এসে একটা গোটা পাঁউরুটি আর দুটো বাসি আলুর চপ আর এক ছড়া কলা ডুলি থেকে বের করে এনে আমার ঘরে লুকিয়ে রাখলাম। বিকেলের জলখাবারের আগে খোঁজ হবে না জানতাম।
আমাকে স্নান করে সকলের সঙ্গে খেতে বসতে দেখে বড়োকাকিমা আর বিভুদা যেমনি অবাক হল, তেমনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ঠিক জব্দ হয়েছে। আমি বাড়ি ছেড়ে পালালে বাবা আর ওদের কাউকে আস্ত রাখবে না! হয়তো এ-বাড়ি থেকেই তাড়াবে! রাখি পিসিমা বলেছে, ঠাকুরদার ঠাকুরদার বাবার তৈরি এই বাড়িটা নাকি বাবার ভাগে পড়েছে, তাই বাবাকে কেউ চটাতে চায় না। আসলে অবিশ্যি রাখি পিসিমার ছেলে হরিশেরই নাকি বাড়িটা পাওয়া উচিত ছিল, কারণ ও বাবার চেয়েও বয়সে বড়ো আর খুব ভালো মাউথ-অর্গান বাজায়।
যাই হোক, আমি আছি দেখে সবাই যেন নিশ্চিন্ত। এমনকী, বিভুদাকে ছোটকা বললেন, চাঁদকে বলেছিস নাকি?
বিভুদা মাথা নাড়ল। ছোটকা বললেন, দেখ চাঁদ, তুই দ্বিতীয় সৈনিক হবি আর অমরেশকে ওই মৃত সৈনিকের পার্টটা দিচ্ছি। ওটা খুব সহজ, বেশি রিহার্সাল লাগবে না, একবার শুধু কোৎ শব্দ করে পড়ে যেতে হবে, তারপর শিশুপাল বধ হওয়া পর্যন্ত, হাত-পা এলিয়ে পড়ে থাকতে হবে।