সমুদ্রের ধারে কালো পাথরের উঁচু পাড়ি, তার ধাপে ধাপে বুনো হাঁসদের বাসা। রাত্রে তাদের সাদা সাদা ছায়ার মতো দেখায়। শীতের শেষে দল বেঁধে তারা উত্তর দিকে উড়ে যায়। সমুদ্রের উপর দিয়ে সমানে উড়ে চলে, ভয়ডর নেই।
কিন্তু খিড়কির পাঁচিল বেয়ে কিছুদূর গেলেই দু-বাড়ির ছায়া মিশে সে যে কী দারুণ অন্ধকার তৈরি করে রেখেছে সে আর কী বলব। তার অনেক নীচে জলের শব্দ। সামনে বেল গাছের পাতা বাতাসে খড়খড় করছে।
চলে গেলাম সেখান দিয়ে পেরিস্তানে। লোকটা কপালে হাত দিয়ে জলের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। আমাকে দেখে দারুণ চমকে উঠল। সাহস দিয়ে বললাম, এ যে আমি, তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার জন্য খাবার এনেছি।
সে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল।
–এনেছ? আঃ, বাঁচালে! সর্বদাই আমার কিছু-না-কিছু খাওয়া চাই। নইলে দুব্বল হয়ে যাই। কই, দাও কী এনেছ।
খেতে খেতে বার দুত্তিন আমার দিকে তাকাল। কিন্তু আমি একটু টর্চটা জ্বালতেই ভারি ব্যস্ত হয়ে উঠল।
ও কী কর কত্তা, ও যে একেবারে কঁচড়াপাড়ার ওধার থেকে চোখে পড়বে, অন্ধকারে খোলা চোখের মতো জ্বলজ্বল করবে। ও কাজও কোরো না। দু-দিন একটু হাড় ক-খানিকে জিরিয়ে নিই। পৃথিবীতে যে এমন একটা শান্তির জায়গা আছে, এ আমি ভাবতেও পারিনি। চাট্টি ভোগ করে নিই। তারপর আবার সেই কুমির-কুমির খেলায় নামতে হবে তো! এত বড়ো বাড়ি তোমার, আমাকে একটা চাকর করেও তো রেখে নিতে পার। তবে আমি অন্য চাকরদের সঙ্গে শোবটোব না, আমাকে আলাদা ঘর দিতে হবে। এই ঘরেই আমার চলে যাবে, এর বেশি কিছু আমার দরকার নেই।
লোকটার কথা শুনে আমি অবাক! বললাম, এ বাড়িটা মোটেই আমার না। তা ছাড়া তুমি কী কাজ করতে জান যে চাকর রাখব?
লোকটা ততক্ষণে খাওয়া সেরে, নদীর জলে হাত-মুখ ধুয়ে আমার কাছে এসে বসেছে। বললে, চাকরি কত্তে হলে কাজ জানা চাই একথা তোমাকে কে বললে? আমি খুব ভালো আঁকতে পারি। ওই যারা সব বড়ো বড়ো সোনার মেটেল পায় আর খেতাব পায়, আমি তাদের চেয়েও ভালো আঁকতে পারি।
পার তো তুমি সোনার মেডেল পাও না কেন?
–তার অনেক অসুবিধে আছে কত্তা। আমি তো আর কাগজে আঁকি না।
কাগজে আঁক না তো কীসে আঁক?
–সে আছে সব, কত্তা, বলব একদিন।
দূরে গির্জার ঘড়িতে রাত বারোটা বাজল। উঠে দাঁড়ালাম, এখন ঘুমোতে যেতে হয়। লোকটা হঠাৎ ফিরে আমার পা দুটোকে জড়িয়ে ধরে বলল, দাও কত্তা, দুটো পায়ের ধুলো দিয়ে কেতাখ করে দাও। আহা ঠাই দিয়ে, আহার দিয়ে প্রাণটা বাঁচালে গো। নইলে পরের জিনিস ঘাড়ে করে বয়ে বেড়াচ্ছি, আমাকে এমন বন্ধু কোন দেবতা দিত হ্যাঁ!
.
ঘরে ফিরে এসে শুয়ে শুয়ে লোকটার কথাই ভাবতে লাগলাম। কালোমাস্টার আবার একটা নাম নাকি? নিশ্চয় ছদ্মনাম। বিশেটাও এর মধ্যে আর আসেনি, ও লোকটা যদ্দিন থাকবে আর আসবেও না। উঃ, পাঁচিল চড়ে চড়ে পায়ে কী ব্যথা! বাড়িতে আমাদের বুড়ো চাকর পাঁচুদা রোজ আমার পায়ে তেল মালিশ করে দিত; কিন্তু এখন থেকে আর দিতে দেব না। পাঁচুদা আমার খাবার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকত, মাছের কাঁটা বেছে দিতে চাইত, দেব ভাগিয়ে। যারা বেশি পুতুপুতু করে মানুষ হয়, বিশে তাদের নাড়ুগোপাল বলে।
ওদের দ্বীপে নাকি চাকর নেই। যে-যার নিজের কাজ নিজে করে। আমি আজকাল রোজ আমার গেঞ্জি কেচে স্নানের ঘরের জানলায় মেলে দিই।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। সকালে ঘুম ভেঙে শুনি রান্নাঘরের দালানে বামুনদিদি মহা রাগমাগ করছে। বাসন মাজে তারিণী, তাকে বলছে, একেবারে বক-নাক্কস গো। রোজ ডুলি খুলে আট-দশখান লুচি খেয়ে নেয়, কিন্তু কাল রাত্তিরে একেবারে এক দিস্তে সাবাড়! ওই বিভুদাদার কপালে অনেক দুঃখু আছে এই আমি বলে দিলাম!
বিভুদাও দালানের ওধারে নিমকাঠি দিয়ে দাঁতন করছিল। কথা শুনে সে তো চটে লাল!
–শুনলে ছোটকা? মোটেই আমি লুচি খাইনি, বামুনদির কথা শোনো একবার! বামুনদিদি ঝনর ঝনর করে বাসন নামাতে নামাতে বলল, না খায়নি। লুচিগুলো কঞ্জুর হয়ে উবে গেছে! কাল দুধের দাঁত পড়তে দেখলুম, আর আজ মুখ থেকে সকাল বেলায় কেমন মিছে কথা বেরুচ্ছে দেখেছ! আজ তোমাকে শুকনো তো দেওয়া হবে দেখো।
দুমদাম করে পা ফেলতে ফেলতে বামুনদিদি লুচি গরম করবে বলে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। বিভুদা গজর গজর করতে লাগল, আমি স্নানের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।
সত্যিই কোথাও একটা ভালো শিশুপাল পাওয়া গেল না। ছোটকা অনেক বলাতে বড়োকাকা প্রকাশদার বাবাকে বোঝাতে গিয়েছিলেন, তা তিনি নাকের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বড়োকাকিমা বললেন, ওই ব্ৰজেনদাই হল গিয়ে নষ্টের গোড়া, ওকে তোরা পাঁচজনে মিলে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে পারিস নে? ও-ই যখন ভাগিয়ে দিয়েছে, ও-ই আনুক-না একটা শিশুপাল!
বিভুদা হই হই করে ছুটে এল, আঃ মা, তুমিই সব ডোবাবে দেখছি! বাইরের ঘরে ব্রজেনদা ছোটকার সঙ্গে ফর্দ করছেন, কথাগুলো ওঁর কানে গেলেই হয়েছে আর কী?
বড়োকাকিমাও রেগে গেলেন, তুই থাম দিকিনি, আমার উপর আর কর্তৃত্ব করতে হবে না! কেন বলব না সত্যি কথা, এক-শো বার বলব।
বিভুদা প্রায় কেঁদে ফেলে আর কী।
–আঃ, মা, কেন বোঝ না যে শুনতে পেলে ব্রজেনদা যদি রেগেমেগে চলে গিয়ে ভোঁদার দলে যোগ দেয়, তখন কি তুমি শ্রীকৃষ্ণ সাজবে নাকি?