–ওই একই হল, আমাদের নাটক করা মানেই ফাস্ট হওয়া।
নোটো রেগে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল। আমাদের রাস্তায় ঢুকেই ছোটকা বললেন, একটা ভালো শিশুপাল জোগাড় হয় কী করে তাই ভাবছি। দাদাকে বলে দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থাটা করে ফেল শিগগির।
আমি বললাম, তুমি যে এক্ষুনি বললে পাঁচশো টাকা পাচ্ছ, আর ভাবনা নেই।
–নাঃ, তুই নিতান্ত গাধা দেখছি। আরে শত্ত্বরকে ও-রকম বলতে হয়, তাও জানিস না? ওদেরও টানাটানি যাচ্ছে। গত বছর একসঙ্গে কাজ হয়েছিল, অনেক চাদা উঠেছিল। এবার দু-দল হয়েছে, চাদাও ভাগাভাগি। তার উপর ওদের জিনিসপত্রও কিছু কিছু খোয়া গেছে নাকি শুনছি। কারো এখন মাথা ঠিক নেই। খুব সাবধানে এগুনো দরকার।
খুপরি ঘরের লোকটা দেখলাম একটা লণ্ঠন তুলে চারদিকে চেয়ে দেখছে। লণ্ঠন একদিকে লাল কাচ, অন্যদিকে সবুজ কাচ। অনেক দূর থেকে লণ্ঠনটাকে দেখা যায়, তার চারপাশ দিয়ে আলো বেরুচ্ছে, কিন্তু লণ্ঠনটা নিয়ে বেশি দূর দেখা যায় না।
রাস্তায় বৃষ্টির জল জমা হয়েছে, ছোটকা গিয়ে খুপরি ঘরের উঁচু জায়গাটাতে উঠলেন, আমিও পিছনে পিছনে গেলাম। ওখান থেকে একবার দেখা দরকার।
বুকের ভেতরে হঠাৎ ছাৎ করে উঠল, যদি দেখি কালো মাস্টার জলের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে! ছোটকা অমনি হই চই করে একটা কাণ্ড বাধাবেন, এদিকের ঘাট থেকে নৌকো নিয়ে ঘুরে ওখানে গিয়ে উপস্থিত হবেন। ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম, তাকাতে ভয় করছিল। আস্তে আস্তে চোখ ঘুরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, নাঃ, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না!
রাত্রে নরম নরম আটার লুচি হয়েছিল, তার সঙ্গে ছোলার ডাল, বেগুনভাজা আর ডিমের ডালনা। বড়োকাকিমা কী ভালো পায়েস করেছিলেন! রান্নাঘরের দাওয়াতে রংচঙে আসনে সারি সারি বসে পাত পেড়ে সবাই খেলাম।
আমাদের খাওয়া হলে ওইখানে কাকিমারা সবাই বসলেন, বড়োরা উঠোনের মস্ত গন্ধরাজ গাছের নীচে তক্তপোশের উপর বসে নাটকের কথা বলতে লাগলেন।
ভোঁদার উপরে বড়োকাকা ছাড়া সকলের কী রাগ! বড়োকাকা পান চিবোত চিবোতে খালি খালি বলতে লাগলেন, তোরা যাই বলিসনা কেন, কাপ নেবে ওরাই। ওদের সঙ্গে তোদের তুলনা! ছোঃ! কী কাজের ছেলে ভোঁদা, আমাদের নতুন দোকানঘরের জন্যে দু-গাড়ি সিমেন্ট পাইয়ে দিয়েছে। দিয়েছি একটা মোটা চাদা। অনেক খুঁটিনাটি জিনিস ওদের কেনা বাকি আছে। বলছিল। কোথায় নাকি সাজের জিনিস আনতে লোক পাঠিয়েছিল, তার কোনো পাত্তা নেই। ভারি ভাবনা ওদের। দেখছিলাম রিহার্সাল, চমৎকার প্লে করছে। শিখে নিলে পারিস।
শুনে কাকিমাদের পর্যন্ত পিত্তি জ্বলে গেল। ছোটকা, মেজোকাকা, বড়দা, মেজদা, বিভুদা সব রেগে উঠে গেল। বড়োকাকা আরেকটু চুন দাঁতে লাগিয়ে বললেন, কী হল? বাবুদের বুঝি রাগ হল? তা তোরাও ওদের মতো ভালো হ-না, তোদেরও প্রশংসা করব। তুই যে বড়ো বসে থাকলি, চাঁদ?
বড়োকাকিমা বললেন, ও তো আর নাটক করছে না, ওর উঠে যাবার কী আছে?
–কেন, ওকে বাদ দিয়েছে কেন? ছোটো পার্টও তো আছে।
-বিভু বলছিল ও তেমন পারবে না, তা ছাড়া পাড়ার পাঁচটা ছোটো ছেলেকে বাদ দিয়ে তো আর ওকে নেওয়া যায় না, এরা কী মনে করবে! হাজার হোক ও থাকে কলকাতায়। তবে বাদ দেওয়া হয়েছে সে আবার কেমন কথা? ও তো বটঠাকুরকে বলে সমস্ত দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা করছে। সেও তো একটা বড়ো কাজ।
বড়োকাকা অবাক হয়ে গেলেন।
–দাদা দাড়ি-গোঁফ কিনে দেবে, এ তো ভারি আশ্চর্য! এরা নাটক করছে শুনে তো ওকে আসতেই দিচ্ছিল না। নাকি যত রাজ্যের বখা ছেলেদের আড্ডা হবে, এইসব বলছিল। তা বাপু নাটক না হলেও তো আর বখা ছেলেদের এড়াতে পারবি নে, তারাই যখন ওর খুড়ো, ওর দাদা। কী-বলিস চঁদ?
ততক্ষণে কাকিমারা উঠে পড়েছেন, আর বামুনদিদি কঁসিতে করে গোছ গোছ লুচি আর বেগুনভাজা আর ঘরে-করা সন্দেশ, ভাড়ারঘরের সামনে জালের আলমারিতে সকালের জলখাবারের জন্যে তুলে রেখেছে। আমি তখন উঠে গেলাম।
একতলাতেই আমার ঘর। জানলার সামনে গঙ্গা, খাটে শুয়ে সেইদিকে চেয়ে চেয়ে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল সে লোকটা তো সেই চাট্টি কুচো নিমকি আর একটা মুড়ির মোয়া ছাড়া আর কিছু খায়নি।
অমনি চট করে উঠে পড়লাম। বাড়ি ততক্ষণে নিঝুম হয়ে গেছে। জালের আলমারি থেকে গোটা কুড়ি লুচি, বেগুনভাজা, সন্দেশ এইসব নিয়ে আমার বয়স্কাউটের থলিতে ভরলাম, জলের বোতলে জল ভরলাম। এ তল্লাটে কেউ নেই যে কিছু বলবে। বামুনঠাকরুনের বাড়ি কাছেই, সে রাত দশটায় চলে যায়, চাকররা সারি সারি দালানে শোয়। সামনে বৈঠকখানা ঘরের পাশে ছোটকার ঘর, তার পাশে বিভুদার ঘর। মাঝখানের দরজা খোলা থাকে, বিভুদার বড্ড ভূতের ভয়! অবিশ্যি বলে নাকি রাতে যদি ছোটকাকে বোঙায় ধরে, তাই খুলে রাখে।
খিড়কির দরজা খুলে গেলাম চলে পেরিস্তানে। পিঠে থলি আর জলের বোতল ঝুলছে, গলায় দড়ি-বাঁধা টর্চ, পেনসিলের মতো ছোটো। ছোটোমামা জন্মদিনে দিয়েছিল।
০৫.
বিশে অন্ধকারকে ভয় পায় না। বলে, ভয় আবার কীসের, কেই-বা আমাকে দেখতে পাচ্ছে অন্ধকারে। ওদের দ্বীপের পথে আলো জ্বলে না। চাঁদ না থাকলে হাজার হাজার তারার আলোতে পথঘাট ফুটফুট করে! ওদের দ্বীপের মাঝখানের স্থির জলে বিরাট বিরাট কচ্ছপ থাকে, তারা রাত্রে জল থেকে ডাঙায় উঠে ঘুমোয়, অন্ধকারে বড়ো বড়ো পাথরের মতো দেখায়।