ছোটকা থাকতে থাকতে ও ঘর থেকে সরে পড়তে ইচ্ছেও করছিল, আবার ওদের কথাবার্তাটা শেষ পর্যন্ত না শুনে যাইই-বা কী করে? যেরকম সব মেজাজ দেখছি, এর পরে যদি মারামারি লেগে যায়, সেও দেখতে পাব না শেষটা!
ছোটকা বললেন, ওরে বিভু, সম্মুখে বিপদ, এখন কি তাতে আমাতে খাঁচাখেচি শোভা পায়? জানিস, ওরা কর্ণার্জুন করছে, কী সব ভালো ভালো ড্রেস আনিয়েছে। ভবেশ রায় নাকি কর্ণ সাজছে।
বিভুদা অবাক!
–কে ভবেশ রায়? সিনেমার ভবেশ রায়? তবে-না লোক ভাড়া করে আনার নিয়ম নেই, মিনি পয়সায় করতে হবে?
–আরে না রে না, ভাড়া করা নয়। ভোঁদাদের পাশের বাড়ির অজানেশবাবু যে ওর মামা হয়। সে-ই আনিয়েছে। পয়সাকড়ি দিতে হবে না। ড্রেসগুলো ওই সস্তায় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দাড়ি-গোঁফ এখনও পৌঁছোয়নি। বুঝলি বিভু, ওরাও চাচাছোলা মুখে রিহার্সাল কচ্ছে! দুটো
স্পাই লাগিয়েছি, তারাই খবর এনে দিচ্ছে। তুই বরং একটা শিশুপালের খবর কর। উঠি বড়দার সেই মক্কেলের বাড়ি গেলে কিছু চাঁদা পাওয়া যায়। জল তো ধরে গেল। কী রে চাঁদ, যাবি নাকি সঙ্গে?
আর বলতে হল না, পাঁচ মিনিটে শুকনো কাপড় পরে আমি ছোটকার সঙ্গে রওনা।
০৪.
মক্কেলের বাড়ি যেতে হলে পুলের মাথা পার হতে হয়। আড় চোখে একবার বাঁকের ধারে আমাদের বাড়িটাকে দেখে নিলাম। গাছ-গাছলায় ঢাকা পুরোনো তিনতলা বাড়ি, চাঁদের আলোতে নদীর ধারে চুপচাপ পড়ে রয়েছে। চাতালটা একেবারে জলের কিনারা ঘেঁষে এগিয়ে রয়েছে, ওরই নীচে এত ব্যাপার কে বলবে! হাসি পেল।
ছোটকা হঠাৎ বললেন, কী রে, নাটক প্রায় ডোবে আর তোর হাসি পাচ্ছে, চাঁদ?
চোখ তুলে চেয়ে দেখি রেলের লাইনের খুপরি ঘরের সেই লোকটা একটা লাল গামছা কেচে টগরফুলের গাছের উপরে মেলে দিচ্ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই গম্ভীর মুখ করে একদৃষ্টে এমন করে চেয়ে থাকল যে আমার বুকের ভেতর জোরে জোরে হাতুড়ি পিটতে লাগল। কতখানি দেখতে পায় কে জানে।
ছোটকা বললেন, নাও, অমন ঢিমেতেতালা চালে চললে তো হবে না, সমরেশবাবু এক বার তাসের আড্ডায় বসে গেলে আর কোনো দিকে হুঁশ থাকবে না।
সমরেশবাবুর দলের লোকেরা তখনও এসে জোটেনি, তাই আমাদের দেখে তিনি মহা খুশি। তক্তপোশের কোনায় একটা রোগা লোক বসে ছিল, তাকে দিয়ে আমাদের জন্য পান আনিয়ে বললেন, দ্যাখ বটু, পাঁচ টাকার নয়াপয়সা ভাঙানি দিতে পারিস? এই তাস খেলে খেলেই দেউলে হতে হবে দেখছি।
ছোটকা বললেন, সে আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি দাদা, কিন্তু তার আগে আপনার সঙ্গে একটু পরামর্শ ছিল। ওই পুজোর নাটক প্রতিযোগিতা নিয়ে
সমরেশবাবু লাফিয়ে উঠলেন, আঁ! আবার ওই পুজোর নাটক? ভোঁদারা আমাদের গোটা বাড়িটার একরকম ছাল ছাড়িয়ে নিচ্ছে ওদের স্টেজ সাজাবে বলে! তোমার বউদির গয়না, বেনারসি কাপড় কিচ্ছু বাদ যাচ্ছে না। একে যদি নাটক বলে তবে বর্গির হাঙ্গামা কাকে বলে বাপ?
দু-চোখ কপালে তুলে ছোটকা বললেন, অমনি ওদের হাতে তুলে দিলেন সব? দেখুন দাদা, এক পাড়াতে মানুষ হয়েছি, একরকম বলতে গেলে ও আমার ভাইয়ের মতো, কিন্তু সেদিন ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আপনার নামে যেসব কথা বলছিল দাঁড়িয়ে শোনা মুশকিল হচ্ছিল।
সমরেশবাবুর মুখটা অমনি গম্ভীর হয়ে গেল।
কী, বলছিল কী?
–সে আর কানে তুলবেন না দাদা, ওসব লোকদের কথা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।
–তবু শুনিই-না কী বলছিল।
–বলছিল যে ও-রকম ঢের ঢের বড়োলোক দেখেছি, দোকানদারি করে সব এক-একটি চাই হয়েছেন। ঘটে যে শুধু গোবর ছাড়া আর কিছু নেই, সে একবার ওর তাস খেলা দেখলেই বোঝা যায়! আরও কী সব বলছিল। এমনি ছাচোড়! অথচ আপনি ওদেরই সাহায্য করছেন আর আমাদের বাড়ির এতকালের পুরোনো ক্লাবটা যে উঠে যেতে বসেছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপও নেই!
রাগে সমরেশবাবুর ঝোলা ঝোলা গোঁফের ধারগুলো মুখের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। সেগুলোকে বের করে না ফেলেই গুম হয়ে বসে থাকলেন। গিলে ফেললেই তো হয়ে গেল! হঠাৎ সেই রোগা লোকটির দিকে ফিরে চাপা গলায় বললেন, এসব কী শুনছি, নোটো?
নোটো বললে, সব মিছে কথা স্যার। ওই মোটা লোকটার একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না। আবার সঙ্গে করে ছোটো ছেলে নিয়ে এসেছে মন গলাবার জন্যে! এবার আমাকে উঠতে হয়, তাহলে চাঁদাটা–
ভীষণ রেগে গেলেন সমরেশবাবু, তক্তপোশে কিল মেরে বললেন, কিচ্ছু দেব না, এক কানাকড়ি চাদা কাকেও দেব না–তুমিও শুনে রাখো বটু– তবে যাদের নাটক সবচেয়ে ভালো হবে তাদের পাঁচশো টাকা বকশিশ দেব।– যাও এখন। বটু, আমার ভাঙানি নয়া পয়সা?
–এই যে আনছি—
বলে এক দৌড়ে ছোটকা কোত্থেকে যেন এই বড়ো এক পুঁটলি নয়া পয়সা এনে দিলেন। আমি তক্তপোশের ধারে রোগা লোকটার পাশে কাঠ হয়ে বসে থাকলাম। কেউ কোনো কথা বলল না।
পথে বেরিয়ে নোটো বললে, দিলেন তো দাদা সব ফেঁসে! আমি অনেকটা পাকিয়ে এনেছিলাম, আজ রাতে কি আপনার না এলেই নয়? ও হ্যাঁ, আপনাদের শিশুপালকে নাকি কান ধরে নিয়ে গেছে?
বোধ হয় ভেবেছিল ছোটকা রেগে যাবেন। ছোটকা কিন্তু হেসে বললেন, এক শিশুপাল গেল, তার বদলে আরও ভালো শিশুপাল আসবে। চুটিয়ে সাজাব স্টেজ, বলবেন গিয়ে ভোঁদাকে। পাঁচশো টাকা যখন সমরেশবাবু দেবে তখন আর ভাবনা কী?
–আহা, ফাস্ট হলে তবে তো!