–বিশে? বিশে আবার কে?
বিশে আমার বন্ধু, হাঙরমুখো নৌকো করে নদীর ওপার থেকে আসে, সঙ্গে থাকে ওর কুকুর, তার নাম সিংহ। এ জায়গাটার নাম পেরিস্তান।
লোকটা ভারি ব্যস্ত হয়ে উঠল।
–বিশে যদি আবার এসে আমাকে দেখে, তাহলে কী হবে?
–হবে আবার কী? ভালোই হবে, ও তোমার শত্রুরদের মেরে পাট করে দেবে। তোমার কোনো ভয় নেই।
–কিন্তু কিন্তু যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে?
লোকটা তো আচ্ছা ভীতু। বললাম, না না, কিচ্ছু ভয় নেই। আমি ওকে বলে দেব। তা ছাড়া আজ আর ও আসবেও না। এখন আমি চলি, তুমি চুপচাপ বিশ্রাম করো। অন্য লোক আছে জানলে বিশে কখনো আসে না। পরে আমিই আবার আসব।
আঁকড়ে-মাকড়ে উঠে, খিড়কির বাগান ঘুরে রান্নাঘর দিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। কাকিমারা আমাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, ও ছেলে! তোমাকে খুঁজে খুঁজে না বাড়িসুষ্ঠু হয়রান!! জলঝড়ে কোথায় ছিলে? ইস্, ভিজে চুপ্পুড় হয়ে গেছ যে! বলি, ছিলে কোথায়?
বললাম, কেন, খিড়কির বাগানে। গাছতলা থেকে নদীর ওপরে ঝড় দেখছিলাম।
–গাছতলা থেকে? কেন? নদী তো ঘর থেকেও দেখা যায়।
-তা দেখা যেতে পারে, এ অন্যরকম দেখা।
বড়োকাকিমা বললেন, যাও-না, তোমার বড়োকাকা তোমার অন্যরকম দেখা বার করবেন।
আস্তে আস্তে বললাম, আর ছোটকা? বিভুদা?
–তারা এসব বিষয় কিছু জানেও না, কেয়ারও করে না। তাদের নাটকের সব্বনাশ হয়ে গেছে বলে যে-যার ঘরে গিয়ে শুয়ে আছে। যাও, এখন কাপড় ছাড়ো তো। বড়োকাকাকে বুঝিয়ে বলব এখন। এমনি ভীতু ছেলে যে অমনি মুখ শুকিয়ে গেছে!
শুনে হাসি পেল। ভীতুরা কি টগবগে ফেনাভরা নালার উপর দিয়ে আধ-হাত সরু জায়গা দিয়ে হাঁটতে পারে?
রান্নাঘরের জলচৌকিটার ওপর বসে বললাম, নাটকের কী সব্বনাশ হয়েছে রে, পুঁটিদি?
পুঁটিদি আমার মেজোপিসির মেয়ে, আমার চেয়ে একটু বড়ো। কী ঝগড়াটে, বাবা! পুঁটিদি বললে, ওমা! তাও জান না? প্রকাশদা-না, রোজ রোজ ব্রজেনদাকে যা নয় তাই বলে অপমান করে! এমনিতে বইতে আছে শিশুপাল শ্রীকৃষ্ণকে যাচ্ছেতাই সব কথা বলছে। ও এমনি খারাপ যে তার সঙ্গে আরও সব জুড়ে জুড়ে দেয়। প্রথমটা নাকি ব্রজেনদা অত টের পাননি, খুব রেগেছেন মনে মনে, কিন্তু ভেবেছেন বলুকগে ছাই, একটু পরেই তো বধ হবে, তখন বাছাধন টেরটা পাবে! তারপর কাল হয়েছে কী, দু-জনার পার্ট-লেখা কাগজ অদলবদল হয়ে গেছে! ব্ৰজেনদা দেখেন অর্ধেক কথা মোটেই পার্টে নেই, প্রকাশদা বানিয়ে বলে, এমনি খারাপ! তখন ব্ৰজেনদা–
পুঁটিদি আরও কীসব বলতে যাচ্ছিল, এমনি সময় বড়োকাকিমার সে কী ধমক, যাও, যাও, আর পাকামো করতে হবে না। একটা লুচিও যার গোল হয় না, তার মুখে আবার বড়োদের নিন্দে! যাও এখান থেকে!
পুঁটিদি সত্যি চলে গেল আর আমিও ভিজে জামা ছাড়তে ঘরে গেলাম।
ঘরে ঢুকেই দেখি লাল লাল চোখ করে বিভুদা আমার খাটের উপরে বসে আছে। তখুনি চলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বিভুদা বললে, চাঁদ, শোন।
আস্তে আস্তে গিয়ে খাটের ওপাশে দাঁড়ালাম। বললাম, কী?
রাগে বিভুদা ফেটে পড়ে আর কী!
কী! কী আবার কী? নাটক বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় তা জানিস? প্রকাশদা রোজ পার্টের কথা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ব্রজেনদাদের অপমান করে, সেই রাগে সকালে ব্রজেনদা জ্যাঠামশায়কে বলে এসেছেন যে এখনও সাবধান হবার সময় আছে। ওদিকে ছেলে নাটক করছেন! এদিকে অঙ্কের পরীক্ষায় যে দশ পেয়েছেন জ্যাঠামশাই কি সে খবর রাখেন? আর যাবে কোথায়, আপিস-ফেরত জ্যাঠামশাই রিহার্সালের মাঝখান থেকে প্রকাশদাকে কান ধরে সারাপথ হাঁটিয়ে বাড়ি নিয়ে গেছেন! সঙ্গে যে অফিসান গাড়িটা রয়েছে সে খেয়ালও নেই! দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা নেই, শিশুপাল নেই, এখন কী করে নাটক হবে শুনি?
এই না বলে এক লাফে খাট পেরিয়ে ধরেছে আমার টুটি চেপে!
–দাড়ি-গোঁফ কবে এনে দিচ্ছিস বল হতভাগা! না এনে দিলে তোর পেয়ারের ছবি আঁকার খাতার আমি কী করি দেখিস!
পেটের ভিতরে সিঁটকে গেলাম আমি! সত্যি যদি খাতাটা ছিঁড়ে ফেলে! ওতে আমি জল-মানুষদের ছবি এঁকেছি! বললাম, শিশুপালের পার্টটা ইচ্ছে হলে আমাকে দিতে পার।
শুনে বিভুদা আমার টুটি ছেড়ে দিয়ে হেসেই কুটিপাটি!
–সে কী রে চাঁদ? তুই হবি শিশুপাল! শিশুপাল যে একটা বিরাট যোদ্ধা ছিল। তোর তো এই চেহারা! বেড়ালছানার পার্ট থাকলে তোকে দিতাম! ওসব কথা ভুলে যা, দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা কর। শিশুপালের বিষয় আমরা ভাবব।
আরও হয়তো গাঁট্টা-টাট্টা মারত আমাকে, বলা যায় না, কিন্তু ঠিক সেই সময় ছোটকা এসে আমার খাটের উপরে বসে পড়লেন। বিভুদা হাত নামিয়ে নিল। ছোটকা বললেন, তবে কি শেষটা সত্যি সত্যি ওই ভোঁদার কাছে হার মানতে হবে নাকি? বিকেলে ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে তোর নামে কীসব নিন্দে-টিন্দে করছিল ওরা।
বিভুদা লাফিয়ে উঠল, কী, আমার নামে বলছিল কী শুনি।
না, অত রেগে ওঠবার মতো কিছু নয়। তবে বলছিল যে ওই বিভুটাকে আমরা ঘোড়াই কেয়ার করি, আছে তো শুধু গোঁয়ার্তুমি আর গুন্ডাগিরি কত্তে! ঘটে যে গোবর ছাড়া আর কিছু নেই সে ইস্কুলেই রোজ টের পাওয়া যায়! বটুদাকে নিয়েই যত ভাবনা!
বটুদা মানে ছোটকা। বিভুদা তো রেগে টং!
বেশ তো, তাই যদি হয়, এখন থেকে নাটকের ভাবনা তুমি একাই ভেবো, আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসো না। আমার দ্বিতীয় পাণ্ডবের পার্টই আমার পক্ষে যথেষ্ট। তা ছাড়া আরও চারটে পার্ট রয়েছে। ওই যথেষ্ট!