বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল, নদীটা এই বুঝি হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে ফেলে। তলাকার সেই সরু নালাটাতে ঘুরে ঘুরে ফেনা হয়ে জল ঢুকছে। আর সে কী গর্জন! তার ওপর দিয়ে যাই কী করে?
বিশেরা দল বেঁধে ঝড়ের রাতে শুশুক মারতে যায়। সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় এই তাদের নৌকো ওঠে, আবার ঝপাং করে এই তাদের নৌকো পড়ে। নৌকোর কানা ধরে আঁকড়ে থাকতে হয়। নইলে কে কোথায় ছিটকে পড়বে আর তাদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না। একবার একটা তিন-হাত লম্বা চিংড়ি, হঠাৎ নাকে এল ঝড়ের গন্ধ। লাফিয়ে উঠে ফিরে দেখি, নালার মুখে ফেনা-জলে হাবুডুবু খাচ্ছে ও কার ছোটো নৌকো? ও তো বিশের নয়। আমার নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল।
০৩.
ইস্, নৌকোতে একটা লোকও আছে দেখলাম– দু-হাতে প্রাণপণে নৌকো আঁকড়ে রয়েছে, মাঝে মাঝে ঠ্যাং দুটো নৌকো থেকে আলগা হয়ে ভেসে যাচ্ছে। জলে-ডোবা লোকদের মাথায় ডান্ডা মেরে অজ্ঞান করে তারপর চুল ধরে হিড়হিড় করে ডাঙায় তুলতে হয়। কিন্তু কাছেপিঠে ডান্ডাও নেই, আর চুল ধরে হিড়হিড় করে টানতে হলে তো আমাকে সুষ্ঠু জলে নামতে হয়, তখন আমাকে কে তোলে তার ঠিক কী? সাঁতারও জানিনে। সর্দি লাগার ভয়ে আমাকে জলে নামতে দেওয়া হয় না।
বিশেদের দেশের ছেলে-মেয়েরা হাঁটতে শিখেই ঝপাং ঝপাং জলে পড়ে সাঁতার কাটে। বিশে একবার একটা জাহাজডুবির নৌকো বাঁচিয়েছিল। ঝোড়ো সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই যেখানে আকাশের সঙ্গে সমুদ্র মেশে, ওইখানে সাঁতরে গিয়ে ঠেলে ঠেলে নৌকোটাকে ওদের দ্বীপের সরুপথ দিয়ে মাঝখানকার স্থির জলে এনে ফেলেছিল। নৌকোতে জন কয়েক বণিক ছিল, তারা বিশেকে ধনরত্ন দিতে চেয়েছিল। তারা প্রাণ হাতে করে ধনরত্নের বাক্স বুকে চেপে আরেকটু হলেই সমুদ্রের নীচে তলিয়ে গিয়েছিল আর কী! তা আর বিশেকে কিছু দিতে চাইবে না? কিন্তু বিশে কিচ্ছু নেয়নি।
এবার চেয়ে দেখি নৌকোটা আরও কাছে এসে গেছে, পাথরের সিঁড়ির এবড়োখেবড়ো ধাপের ওপর থেকে হয়তো চেষ্টা করলে চুলের মুঠি ধরাও যায়। আমাকে দেখে লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ধরো দড়িটা, নৌকো যেন ভেসে না যায়।
বলে একটা মোটা দড়ি ছুঁড়ে দিল। আমি দড়ি আঁকড়ে চোখ বুজে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লাম। চোখ খুলে দেখি নৌকো ছেড়ে সে এসে ডাঙায় উঠেছে। আমার হাত থেকে দড়ি নিয়ে দেখতে দেখতে দারুণ এক গিঁট দিয়ে দেয়ালের আংটার সঙ্গে নৌকো বেঁধে ফেলল। বলল, মাঝদরিয়ায় এমনি করে বয়ার সঙ্গে নৌকো বাঁধে।
তারপর কুকুরের মতো গা ঝাড়া দিয়ে জল খসিয়ে বললে, উঃফ, আরেকটু হলে মরেই গিয়েছিলাম। বাপ, কালো মাস্টার জলে ডুবে মলো ভাবতেও হাসি পায়! এই, একটা শুকনো কিছু দিতে পার? কান দুটো যে পাতকো হয়ে গেছে, মোটে কিছু শুনতে পাচ্ছি নে।
দিলাম পকেট থেকে ময়লা রুমালটা। লোকটা একবার সেটাকে নেড়েচেড়ে, নাকে তুলে দু-বার শুকে, অমনি পাকিয়ে পাকিয়ে লম্বা একটা খোঁচা বানিয়ে, নিজের কান থেকে রাশিরাশি জল বের করে ফেলল। তারপর বললে, ওয়া! ওয়া! বেড়ে গন্ধ তো তোমার রোমালে, জিভে যে জল এসে গেল।
বললাম সত্যি কথা। রান্নাঘরে গিয়ে বামুনদিদির কাছ থেকে ওতে করে গরম-ভাজা বেগুনি এনেছিলাম। সে বললে, আহা! আছে নাকি কিছুমিছু? খিদেয় যে পেট জ্বলে গেল।
থাকে আমার কাছে সর্বদাই কিছু-না-কিছু। উঠে একবার চোরাকুঠিতে যেতে হল। সেও চলল আমার সঙ্গে সঙ্গে। মোমবাতির আলোতে ঘর দেখে একেবারে হাঁ!
–ই কী! বাড়ির তলায় আবার লুকোনো ঘর কেন? কী কর এসব ঘরে তোমরা?
বললাম, কিছু করি না, আমি ছাড়া কেউ এঘরের কথা জানেও না। আমিও জানতাম না। নেহাত বিভুদা আমাকে দুকান চেপে শূন্যে তুলে মামাবাড়ি দেখাবে বলে তাড়া করেছিল, তাই। আমি পালাতে গিয়ে খিড়কির বাগান দিয়ে পাঁচিলে চড়ে কেমন করে বাড়ির এপাশে চলে এলাম। তারপর একটা জায়গায় পৌঁছোলাম সেটা একেবারে পাশের গুদোমবাড়ির গা ঘেঁষে গেছে। মাঝখানে এতটুকু কঁক, নীচে আবার জল। সেই ফাঁক দিয়ে গলে খানিকটা কার্নিশের মতো দিয়ে হেঁটে একেবারে এখানে এসে গেলাম।
লোকটা বললে, ওয়াঃ!! বেড়ে জায়গাখানি তো! বাড়িটা কি তোমার নাকি?
বললাম, না, মানে আমার ঠাকুরদাদার ঠাকুরদাদার বাবা বাড়িটা বানিয়েছিলেন। এর একটা ইটও ভালো মানুষের পয়সা দিয়ে কেনা হয়নি, বিভুদা বলেছে।
লোকটা বললে, আহা! শুনলেও কান জুড়োয়। তা, এখানে দুটো দিন একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারি কি? শত্রুররা বড্ড পেছনে লেগেছে, খালি পেটে ভিজে গায়ে আর কত লড়া যায়?
বিস্কুটের টিন খুলে ওকে ঝুরো নিমকি আর মুড়ির মোয়া খেতে দিলাম। ছোটো বোতলের জলটাও ওকেই দিলাম; বড়োটা রাখলাম, বিশেতে আমাতে আর সিংহতে খাওয়া যাবে। লোকটার পরনে শুধু একটা কালো হাফপ্যান্ট, ভিজে সপসপ করছে। আর একটা হাতওয়ালা গেঞ্জি, গায়ের সঙ্গে লেপটে রয়েছে।
তাকের ওপর থেকে চাদরটা দিলাম। সেইটে পরে প্যান্ট গেঞ্জি নিংড়ে বেদিটার উপর মেলে দিয়ে খেতে বসল। খেতে খেতে বললে, বারে বারে ইদিক-ঊদিক তাকানো কেন?
বললাম, বাইরে যা জলঝড়, ওরা হয়তো এতক্ষণে আমার জন্য খোঁজাখুঁজি লাগিয়ে দিয়েছে। এই জায়গাটা খুঁজে পেলেই তো হয়ে গেল। আমারও একটা লুকোবার জায়গা থাকবে না, বিশেও আর আসবে না!