আমি পেরিস্তানে গেলাম। কথাটা বিশেকে না বললেই নয়। বিশে এর একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না। হয়তো সিংহকে দিয়ে চাটাবে। কুকুরকে কী ভয় পায় বিভুদা! নাকি ছোটোবেলায় ওর খাটে হুলোবেড়াল উঠেছিল, সেই থেকে ও কুকুর দেখলে ভয়ে কাদা হয়ে যায়! একবার সিংহকে যদি দেখে, তবেই ওর হয়ে গেল!
পেরিস্তানের মাথার ওপরটা ঢাকা, ওপরে তাকালে থাম্বার উপরে-বসানো বাড়ির তলাটা দেখা যায়, কিন্তু বাড়ির কোনোখান থেকে এ জায়গা দেখা যায় না!
এখানে দুটো চোরা কুঠরি আছে সেকথা কেউ জানে না। নালা থেকে বাড়ির তলায় ছোটো সিঁড়ি বেয়ে চোরা কুঠরিতে ঢোকা যায় তাও কেউ জানে না। চোরা কুঠরির দেয়ালে পাথরের তাক আছে, পাথরের বেদি আছে, তাতে শোয়া যায়। কেউ সেসবের কথা জানে না। জানে শুধু বিশে আর সিংহ আর আমি। তাকে দু-তিনটে বই রেখেছি, একটা বিস্কুটের টিনে কিছু খাবার রেখেছি। সিংহর কিনা খুব খিদে। আমাদেরও খিদে পায়।
পেরিস্তানের ভেতর দিকটা যেমনি অন্ধকার, বাইরেটা তেমনি আলো, ঢালু হতে হতে নদীতে নেমে গেছে। কত গাছ-গাছলা গজিয়েছে সেখানে, নৌকো করে সামনে দিয়ে গেলেও জায়গাটা তত চোখে পড়ে না। পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকি, কেউ টেরও পায় না।
ভয় খালি ওই রেলের লাইনের খুপরি ঘরটাকে। ওইখানে একটা বিশ্রীমতন লোক থাকে, কী লাল লাল চোখ তার। গাড়ি যাবার সময় একটা সবুজ নিশান নাড়ে আর কোনো কাজ করে না। খুপরি ঘরটা খানিকটা উঁচুতে একটা বাঁকের উপরে। ওর পেছন দিকের জানালাটা খুলে ঝুঁকে দেখলে হয়তো পেরিস্তানের খানিকটা দেখা যেতেও পারে। এই আমার ভয়।
তাহলে আর বিশে আসবে না। লোকের সামনে ও কিছুতেই বেরোয় না। বলে আমাদের দেশের লোকেরা ভালো নয়, ওদের দেশে সব অন্যরকম। ওদের ইস্কুলের বড়ো ছেলেরা কক্ষনো ছোটোদের পেছনে লাগে না। তবে বিশে আজকাল আর স্কুলে যায় না। কেন যাবে? সব ওর শেখা হয়ে গেছে। ওদের দেশের লোকেরা কেউ বই পড়ে পাস করে চাকরি করে না। ওদের দেশে আপিস নেই।
খালি খোলা মাঠ আর গাছপালা আর নদী আর ঘন বন আর একটা পুরোনো আগ্নেয়গিরি আর মাঝখানে খানিকটা সমুদ্র, সেখানে ঢেউ ওঠে না। আর চারদিকে যে-সমুদ্র তার শেষ নেই। তিনতলার সমান ঢেউ দিনরাত শুধু কালো কালো পাথরের উপরে আছড়ে পড়ছে আর চারদিকের জল ফেনিয়ে দুধের মতো সাদা হয়ে উঠছে।
প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, এমনি সময় কানের কাছে কীসের শব্দে চমকে উঠে বসেছি।
ঝুপ করে অমনি টান হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। কেউ না দেখতে পেলে বাঁচি!
ও কাদের চ্যাঁচামেচি? পেরিস্তানে আবার কে চাঁচাচ্ছে?
মাটি আঁকড়ে কাঠ হয়ে পড়ে আছি, নাকে ঘাস ঢুকছে, গালের উপর দিয়ে অনেকগুলো ঠ্যাংওয়ালা কী যেন হাঁটছে, তবু নড়ছি-চড়ছি না, নিশ্বাস চেপে রাখছি।
কানের কাছ দিয়ে কলকল ছলছল করে নদী বয়ে যাচ্ছে, চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। ওপারের ঘাটে অন্ধকার জমা হচ্ছে। বুক ঢিপঢিপ করছে।
অন্য লোক যদি পেরিস্তানের কথা জেনে ফেলে তবে আর বিশে আসবে না।
বিভুদাদের বিশে কী ঘেন্নাটাই করে। বলে, ব্যাটার শরীরটা তোর চেয়ে তিন ডবল বড়ো, ওর লজ্জা করে না তোর সঙ্গে লাগতে। তুই কিছু ভাবিস না, একদিন হতভাগাকে দেখে নেব!
কী গায়ে জোর বিশের। কী ভীষণ সাহস! বিভুদাকে এতটুকু ভয় পায় না। বুকে গুমগুম করে কিল মেরে বলে, তুই দেখে নিস রে চাঁদ, ওটাকে কেমন মাটির সঙ্গে একেবারে বিছিয়ে দিই। চালাকি করবার জায়গা পায়নি, ছোটো ছেলের সঙ্গে লাগতে আসা! আচ্ছা, আমিও আছি!
দূরে পুলের ওপর দিয়ে আরেকটা মালগাড়ি চলে গেল, টং লিং টং লিং টং লিং। বিশে মাঝে মাঝে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে ওঠে-নামে।
আস্তে আস্তে মাথা তুলে উঠে বসলাম। কোথাও কিছু নেই। এই জায়গায় কী অন্ধকার! নদীর ওপর মিটমিট করে কত নৌকোতে বাতি জ্বলছে। ওপারের ঘাটের আলোগুলো থামের মতো লম্বা লম্বা ছায়া ফেলছে। চোখ তুলে চেয়ে দেখি, আমার মাথা থেকে খানিকটা উঁচুতে, ছোটো একটা গর্ত দিয়ে একটুখানি আলো আসছে। একটা টাকার মতো ছোটো একটা গোল ফুটো। বিশে একবার ওদের দ্বীপের আগ্নেয়গিরির বেয়ে উঠে, ওপর থেকে ঝুঁকে দেখেছিল অনেক নীচে টগবগ করে গলন্ত পাথর ফুটছে আর ধোঁয়া উঠছে আর গন্ধকের গন্ধ আসছে।
খচমচ করে গিয়ে উঠলাম ফুটোর ধারে। চোখ লাগিয়ে তাকিয়ে দেখে আমি থ। আরে, ও যে আমাদেরই বাড়ির চাতাল! ওইখানেই তো বিভুদাদের রিহার্সাল চলছে। ছোটোকাকা হাত-পা নেড়ে খুব বকাবকি করছেন। সব দেখা যাচ্ছে, সব শোনা যাচ্ছে। ভারি একটা গোল হচ্ছে।
এমনি সময় দালানের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন নলিনজ্যাঠা, প্রকাশদার বাবা। রাগে মুখটা কী দারুণ লাল দেখাচ্ছে। বড়ো বড়ো পা ফেলে গিয়ে পাকড়ে ধরলেন প্রকাশদার কান! বললেন, ওঃ! আবার লাটক হচ্ছে! লজ্জা নেই হতভাগা, জানিস পরীক্ষায় অঙ্কে দশ পেয়েছিস! চল, একবার বাড়ি চল, পাঁচ বচ্ছরের মধ্যে আর তোকে ছাড়া নয়!
বলে দিব্যি তার কান ধরে নিয়ে চললেন!
ছোটোকাকা এতক্ষণে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন, ও কী, ও যে আমাদের শিশুপাল!
প্রকাশদার বাবা কাঁধ থেকে ছোটকার হাতটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন।
বাকিরা যে-যেখানে ছিল সেইখানেই বসে পড়ল! আমিও আস্তে আস্তে নেমে এলাম। নেমে এদিকে তাকাতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। হুড়মুড় করে নালাটা দিয়ে জল ঢুকছে। গাছের সমান উঁচু সব ঢেউ উঠছে। ঢেউগুলোর মাথায় ফেনার ঝুঁটি। বাড়িটার তলা থেকে অদ্ভুত একটা গুমগুম শব্দ বেরুচ্ছে। হাওয়া থেকে অমনি গরমটুকু চলে গিয়ে গায়ে লাগল ঠান্ডা।