কী চমৎকার দেখাচ্ছিল ওকে! রং মেখে ফর্সা ধবধব করছে, লালচে দাড়ি-গোঁফ চুল পরেছে, যেখানে-সেখানে গয়না জুলজুল করছে, ভুরু দুটোকে সোজা করে টেনে মাঝখানে জুড়ে দিয়েছে, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে; মাথার ওপর মণিমাণিক্য-দেওয়া পাগড়ি পরে এই এতখানি উঁচু দেখাচ্ছে; গায়ে মখমলের সাজ, হাতে একটা গোলাপ ফুল। সত্যিকার রাজা দেখেছিলাম একবার, কালো কোটপ্যান্ট পরা, সে এর কাছে দাঁড়াতেও পারত না। কানের পেছনে একটু আতর মেখে নিয়ে এক্ষুনি বধ হতে যাবে, বীর আর কাকে বলে!
আমরা যে অভিনয় করছি ভুলে গেলাম। মনে হল সত্যি সত্যি পঞ্চপাণ্ডব এসেছেন, ওই বুঝি শ্রীকৃষ্ণ– তবে শ্রীকৃষ্ণের হাতের গয়নাগুলো বড্ড কেটে বসেছিল, সাজের বাবুরা তাই নিয়ে হাসাহাসি করছিল, কেষ্টঠাকুরের গতর কত! ব্রজেনদা মনে মনে রেগে টং।
শেষ দৃশ্যে শিশুপালের অভিনয় দেখে সবাই কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছিল, তারই মধ্যে একটা চাপা শোরগোল শোনা গেল– চুপ চুপ শব্দ, খুব নড়াচড়া, কারা যেন বেরিয়েও গেল। সব যখন শেষ হয়ে যাচ্ছে, আমার পর্যন্ত কান্না পাচ্ছে, হঠাৎ অবাক হয়ে দেখি, দু-দিকে চেয়ারের সারি, মাঝখানে যাবার রাস্তা, তারই মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে ভোঁদা চেঁচাচ্ছে আর বড়োকাকা, ছোটকা আরো দশ-বারোজন বড়োরা ওকে ধরে, একরকম ঠেলতে ঠেলতে দরজার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্য লোকেরা সবাই মিলে বলছে সসস, তারই মাঝখানে শিশুপাল মরে গেল, স্ক্রিন পড়ে গেল। আর সে কী আকাশ-ফাটানো হাততালি!
হাততালির মাঝখানে আর-একবার স্ক্রিন উঠল, আর সমরেশবাবু ছুটে এসে, খচমচ করে স্টেজে চড়ে, মাইকের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বললেন, শিশুপাল-বধকেই আমরা পাঁচ-শা টাকা পুরস্কার দিলাম, আর শিশুপালকে বিশেষ পুরস্কার দেড় ভরি সুবর্ণপদক।
শিশুপালও ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, সমরেশবাবু অমনি তাকে বুকে জাপটে ধরেছেন, সঙ্গেসঙ্গে ধন্য ধন্য রব আর আবার স্ক্রিন পড়ে যাওয়া!
এতক্ষণ স্টেজেই এত আনন্দ-কোলাহল হচ্ছিল যে বাইরের কথা কারো মনে ছিল না। এবার চারদিক থেকে কিলবিল করে লোকেরা সব স্টেজে উঠতে লাগল। বড়োকাকা, ছোটকা, ভোঁদা, সেই চিত্রতারকা ভবেশ রায়, আর ওদের দলের আরও কত কে। কী রাগ সবার!
বড়কাকা বললেন, চাঁদ!
শুনে আমি থ! আমরা জিতেছি, কাপ পেয়েছি, তবে এরা এত গম্ভীর কেন! আর শুধু গম্ভীর কী বলছি, ভোঁদারা তো রেগে থরথর করে কাঁপছে।
বড়োকাকা বললেন, দাঁড়াও, কেউ যেয়ো না। ভবেশবাবু, দাড়ি-গোঁফ চিনে নিন। এগুলোই কি আপনাদের? একটু ভেবে বলবেন।
ভবেশ রায় গেল ঘাবড়ে, এর দাড়িতে হাত দেয়, ওর চুল দেখে, মুখটা কাচুমাচু, বললে, না, মানে দাড়ি-গোঁফ কি আর সে রকম চেনা যায়? সব সময়ই ওদের চেহারা বদলায়!
দারুণ চমকে উঠলাম, এ যে কালো-মাস্টারেরই কথা! কিন্তু কালো-মাস্টার কই? এক্ষুনি যেখানে ছিল এখন তো আর সেখানে নেই!
ছোটকা বললেন, বিশে কোথায়, চাঁদ? সে নাকি এদের দাড়ি-গোঁফ চুরি করে পালিয়ে এসেছে?
আমি ভয়ংকর রেগে গেলাম, হাত-পা ছুঁড়ে বললাম, না, না, না, ও কক্ষনো চোর না! বড়োকাকা বললেন, জিনিসই নেয়নি. তো চোর কীসের? আপনাদের দাড়ি-গোঁফ ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
ভোঁদা বললে, কিন্তু কিন্তু তাহলে তোমরা কাপ পাও কী করে? ও সাজ তো আমাদের!
সমরেশবাবু বললেন, আহা, কী জ্বালা, সাজের জন্যে তো আর কাপ দেওয়া নয়! অভিনয় কত্তে হয় তো এরাই করেছে। কিন্তু মশায়, ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো, কিছুই যে বুঝলাম না।
ভোঁদা বললে, কী আবার ব্যাপার? ভবেশ ওকে আনল, বললে আমাদের থিয়েটারের মেকাপম্যান, নাম কালো-মাস্টার, এত ভালো সাজাতে কেউ পারে না; তা সে বেটা একদিন রিহার্সাল দেখেই বলে, আমাকে কর্ণ সাজাও, ভবুবাবু কিছু পারছে না! ব্যস্, ওই ওর এক কথা! এদিকে ভবেশ করছে কর্ণ, যা-তা একটা বললেই তো আর হল না! তখন কালো-মাস্টার করল কী, স্রেফ দাড়ি-গোঁফ নিয়ে কেটে পড়ল। কোম্পানিকে টাকা দেওয়া হয়ে গেছে, আর আমাদের টাকা কোথায় যে আবার দাড়ি-গোঁফ ভাড়া করব? বলুন দেখি, কী অন্যায়! আবার আমাকে হল থেকে ঠেলে বের করে দেওয়া হয়েছে!
কখন বাবাও এসে স্টেজে উঠেছেন আমি দেখিনি। আমার দিকে ফিরে বাজের মতো গলায় বললেন, চাঁদ কোথায় পেলে ওকে? সে যা-ই হোকগে, ওকে এখন ধরা হোক, হাজতে পোরা হোক। কিন্তু কোথায় ওর সঙ্গে আলাপ হল, হতভাগা?
আর কি আমি সেখানে থাকি! এক নিমেষে একেবারে হাওয়া। পেছনে শুনলাম একটা হই-হই ধর-ধর শব্দ, তারপরেই পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে, পাঁচিলে চড়ে সরু ফাঁক দিয়ে গলে, নালা ডিঙিয়ে একেবারে পেরিস্তানে!
বুকটা ঢিপঢিপ করছিল। এমন সময় শুনলাম টং লিং টং লিং–টং লিং করে পুলের ওপর দিয়ে মালগাড়ি যাচ্ছে, স্যান্ডো বেরিয়ে এসে সবুজ নিশান নাড়ছে, আর সঙ্গেসঙ্গে ওরই ঘরের ছাদ থেকে গেঞ্জি-পরা কালো একটা লোক মালগাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত নাড়তে নাড়তে চলে গেল। উঃ, আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম!
এতক্ষণে খেয়াল হল আমি একা নই, আমার সামনে আমার সমান বয়সের একটা ছেলে আর তার চেয়ে একটু ছোটো একটা মেয়ে আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আর একটা পোড়া হাঁড়ির মতো মুখওয়ালা লেজকাটা কুকুর আমার পায়ের গোড়ালি শুকছে।