বড়োকাকা বললেন, না দিলে তো আমাদের বাবুরা চোখে সর্ষেফুল দেখবেন, কান অবধি সব দেনায় ডুব রয়েছেন! বটুকে কান্তা কেবিনের পথ দিয়ে হাঁটা বন্ধ করতে হয়েছে, ধারে আর ক দিন চালানো যায়!
কালো-মাস্টারও বললে, আপনারা ভাববেন না, স্যার, আমরা মেরে বেরিয়ে যাব। নইলে আমার নাম কা– উঃ! চিমটি কাটছ কেন চাঁদ?
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, কোথায় চিমটি কাটলাম! চেয়ারের ফাঁকে তোমার ওখানটা চিপকে গিয়েছে বোধ হয়।
পরে বললাম, আচ্ছা, তোমার কি এত দিনেও একটু আক্কেল-বুদ্ধি হল না, আর-একটু হলেই তো সব ফেঁসে যাচ্ছিল। আমি ভুলে যাই যে তুমি সত্যিকার বিশে নও, আর তুমি ভুলতে পার না?
কাছেপিঠে তখন কেউ ছিল না, কালো-মাস্টার চট করে আমাকে একটা প্রণাম ঠুকে বললে, আহা, তাই যেন হয়, স্টেজে উঠে সবাই যেন তাই ভাবে। একটা কথা ছিল, কত্তা, অভয় দাও তো বলি।
বললাম, কী কথা বলো।
সে বললে, কাপ তোমরা পাবে ঠিকই, সমরেশবাবুও তোমার বড়োকাকার হাতে পাঁচ-শো টাকা খুশি হয়ে দিয়ে দেবে। সব হবে, কিন্তু সন্ধ্যেটা নির্বিঘ্নে কাটবে বলে মনে হয় না। তোমার বড়োকাকাকে একটু ডাকো দিকিনি, দুটো দরকারি কথা আছে।
ডাকলাম বড়োকাকাকে, লাইব্রেরি ঘরের একটা ফালি বারান্দা, সেখান থেকে গঙ্গা দেখা যায়, সেইখানে নিরিবিলি গিয়ে আমরা বসলাম। কালো-মাস্টার বললে, স্যার, সন্ধ্যে বেলায় কয়েকটা ষণ্ডা-গোছের ভলেন্টিয়ার রাখবেন, যে-ই গোলমাল করবে তাকেই যেন বাইরে নিয়ে যায়। আর অচেনা অজানা বাজে লোকদের খবরদার ঢুকতে যেন না দেয় আমার অনেক শত্রুর স্যার, নাটক পণ্ড করে দিতে পারলে তারা ছাড়বে না। হ্যাঁ, তবে আমার বন্ধু স্যান্ডোকে বারোটা টিকিট দিয়েছি, তারা বারো জন আসবে। কোনো ভয় নেই স্যার, তাদের কতক কতক বলে রেখেছি, কেউ গোল করলেই তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে বাইরে নিয়ে যাবে কিছু বললেন?
বড়োকাকা বললেন, কাজটা কি খুব ভালো হবে, বিশু? সবাই আমাদের নিমন্ত্রিত অতিথি, একটু যদি গোলমালও করে– এই যেমন কাল বটুরা কতবার শেম শেম বলে চেঁচিয়ে এল ভোঁদাদের অভিনয় দেখতে গিয়ে।
কালো-মাস্টার হেসে ফেলল, ও-রকম গোলমালের কথা বলছি না, স্যার, আজকের অভিনয় দেখে অমন কথা কারো বলতে ইচ্ছেই করবে না। আমি বলছিলাম, আমার শত্তুররা যদি আমার নাটক করা বন্ধ করে দিতে চায়– ধরুন আপনাদের কাছেই যদি মিছে কথা লাগিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে যায়–
বড়োকাকা বললেন, সে আমরা দেব কেন? সবই যখন শুনলাম, তখন বিভুর দলকে ডেকে ওদের ছাতুপেটা করে দেব-না– তোমার কোনো ভয় নেই, বিশু। আরে, চাঁদ দিনরাত তোমাদের সাহসের আর গুন্ডাপনার গল্প করে করে আমাদের কানের পোকা নড়িয়ে দেয়, তুমি এখন ভয় খেলে চলবে কেন? চলো, আর খুব বেশি সময়ও নেই, সাজপোশাক শুরু কত্তে হয়।
কালো-মাস্টার বললে, কিন্তু যদি পুলিশ আসে? ওরা ধরুন পুলিশের কান ভাঙিয়ে তাদের সঙ্গে করে নিয়ে এল? কিংবা নিজেরাই ধরুন পুলিশ সেজে এল? থিয়েটার-করা লোক সব, চেনবার জো থাকবে না!
বড়োকাকা এবার ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, তা হলে কী হবে, বিশু?
কালো-মাস্টার হাসল, আরে, এতটুকুতেই মুষড়ে পড়লেন? আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না, শুধু গেটের ভলেন্টিয়ারদের বলবেন যে অচেনা লোকদের ঢুকতে দেবে না। আমার বন্ধু স্যান্ডোর দল একটা করে গাদাফুল কানে গুঁজে আসবে, তাই দেখে তাদের চিনবে। তা ছাড়া কিন্তু পুলিশ এলেও বাইরে বসিয়ে রাখবে নাটক না ভাঙা পর্যন্ত। তারপর নাটক ভাঙলে পর, আপনাদের কাপ পাওয়ার কথা সবাই শুনলে পর, স্বচ্ছন্দে আমাকে যার খুশি ধরে নিয়ে যেতে। পারে। অবিশ্যি যদি আমার নাগাল পায়।
এই বলে কালো-মাস্টার উঠে পড়ে সাজগোজের ব্যবস্থা করতে গেল।
১২.
আমাদের ওই নাটকের বিষয় বেলুড় বালি থেকে হুগলি উঁচড়ো বদ্যিবাটি পর্যন্ত লোকরা আজও গল্প করে। এমন নাটক কেউ দেখেনি। যেমনি তার সাজসজ্জা, তেমনি অভিনয়ের বাহাদুরি। আজও লোকে বলে সবচেয়ে ভালো অভিনয় করেছিল বিশ্বনাথ বলে লোকটা, যদিও তার সত্যিকার পরিচয় এখন রহস্যে ছড়ানো। সব বলছি।
চমৎকার করে স্টেজ সাজানো, পেছনে গঙ্গার কুলকুল কলকল শব্দও শোনা যাচ্ছে না, পাপা পোঁপো করে এমনি ভালো বাজনা বাজছে। তা আর বাজবে না! দি গ্রেট গ্যাঞ্জেস কত্সার্ট পার্টি যে বড়োকাকিমার মাসতুতো ভাইয়ের নিজের দল।
দেয়ালে সব গাদাফুলের তোড়া ঝোলানো হয়েছিল, তাতে বিভুদাদের দলের পাণ্ডা সুকুমার নিজের হাতে পিচকিরি দিয়ে গোলাপজল ছিটিয়ে দিয়েছিল, চারদিক গন্ধে ভুরভুর করছিল। আমি একবার পর্দা ফাঁক করে উঁকি মেরে দেখি বাবা! শুধু মাথা– গুনগুন করে সব কথা বলছে, মৌচাকের মতো শব্দ হচ্ছে। একটু পেট ব্যথা করতে আরম্ভ করে দিয়েছিল, অতগুলো লোকের সামনে দ্বিতীয় সৈনিক সেজে আমি ধপ করে পড়ে মরি কী করে! ভাবছিলাম ওরই মধ্যে কোথাও স্যান্ডো আর তার বন্ধুরা বারোজন কানে গাদাফুল গুঁজে বসে আছে, বিশের শত্তুররা এতটুকু ট্যা-ফু করলেই তাদের টুটি চেপে ধরবে।
তারপরেই কোথায় একটা ঘণ্টা বাজতে লাগল, আমার তো হাত-পা ঠান্ডা! বারে বারে বিশের মানে কালো-মাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস পেতে চেষ্টা করলাম। তা ওকেও কি চেনবার জো ছিল! আমাদের সবাইকে সাজিয়েছে কলকাতা থেকে আনা সেই কোম্পানির লোকেরা, শুধু কালো-মাস্টার নিজে সেজেছে।