কালো-মাস্টার ব্যস্ত হয়ে বললে, কী নামটা লোকটার বললেন? দু-শো টাকা নিয়েছে? বেশি নিয়েছে। দেওয়া উচিত হয়নি। আমাদের
বাবা চমকে গিয়ে ছোটকাকে বললেন, ও কে বটু? ওই তো আমাকে চা খাওয়াল।
বড়োকাকা বললেন, ও আমাদের বিশু, চাঁদের বন্ধু। শিশুপালের বাবা তার কান ধরে টেনে নিয়ে যাবার পর বটুরা তো কেঁদে ভাসাতে লাগল, তখন চাঁদ গিয়ে ওর বন্ধু বিশুকে ধরে নিয়ে এল। তাই তো আমরা বেঁচে গেলাম।
বাবা বললেন, ও। বলে অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। আমিও অমন ভালো পায়েসটাকে না খেয়েই গুটিগুটি কেটে পড়লাম আমার শোবার ঘরের দিকে। সেখানে নিমকি খরগোশের খাঁচা মাথার কাছে রেখে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। ওর কী মজা! ওর জীবনে কোনো ভাবনা চিন্তা নেই।
সসস
চমকে ফিরে দেখি খিড়কির বাগানে দাঁড়িয়ে কালো-মাস্টার আমাকে জানালা দিয়ে ডাকছে। আস্তে আস্তে গিয়ে বললাম, কী?
কালো-মাস্টার বললে, মাপ দ্যান কত্তা, আমার জন্যে আপনাকে কতই-না ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হচ্ছে। আর তো কালকের দিনটি, কাল তোমাদের কাপ পাইয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে যাব, আর বিরক্ত করব না। আর দেখো কত্তা, পরে যদি কেউ কিছু বলে কালো-মাস্টারের নামে, কিছু বিশ্বাস কোরো না। আর তোমার বন্ধু বিশের কাছে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ো।
কান্না পেতে লাগল, গলার কাছটাতে ব্যথা করতে লাগল। এত সব হাঙ্গামার মধ্যে বিশের কথা মনেও ছিল না। বললাম, ও কালো-মাস্টার, আর গেছিলে পেরিস্তানে? আমি যে যেতে পারি না, নিমকি আমাকে ছাড়েও না, আবার পাঁচিলে চড়তেও ভয় পায়।
কালো-মাস্টার জিভ কেটে বললে, পাগল! বিশের আর সিংহের পায়ের ছাপ দেখেছি, আর কি আমি যাই সেখানে? তার নামে চরে বেড়াচ্ছি। এখন কালকের দিনটা ভালোয় ভালোয় কাটলে বাঁচা যায়। তার একেবারে কঞ্জুর হয়ে যাব, এ এলাকায় কেউ আমার টিকিটি দেখতে পাবে না- ও কী কত্তা, তোমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে নাকি?
চোখ মুছে বললাম,
–ধেৎ! অম্বলটা বড্ড ঝাল ছিল কিনা! কিন্তু ও বিশের আর সিংহের পায়ের ছাপ নয়, কালো-মাস্টার, আর কেউ এসেছিল।
–সে আবার কী, কত্তা? কী করে জানলে তুমি?
আমি খালি বললাম, সে আমি জানি, কালো-মাস্টার। তাদের আসা সম্ভব নয়।
কালো-মাস্টার চলে যাবার অনেকক্ষণ পর মা শুতে এসে আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বা রে, এই এক মাসে তুই তো দিব্যি বড়োসড়ো হয়ে উঠেছিস চাঁদ! হাত-পাগুলো কী শক্ত রে বাবা! আর দেখ চাঁদ, তোর বাবা বলছিলেন কি ওই রকম আজেবাজে বয়সে-বড়ো লোকদের সঙ্গে ভাব করিস নে আর, তুই এখনও ছোটো ছেলে–
আমি বললাম, না মা, নিমকি ছোটো ছেলে, আমার এগারো বছর কবে পূর্ণ হয়ে গেছে। বিশেরা– ওই অবধি বলে থেমে গেলাম।
মা বললেন, সেই কথাই তো বলছি, ওই বিশুটির বয়স কম করে ধরলেও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের কম নয়–।
আমি বললাম, কী যে বল মা, ও তো পঁচিশ বছর ধরে থিয়েটারেই কাজ কচ্ছে, বেশ বুড়ো আছে। তা ছাড়া
মা বললেন, তা ছাড়া কী? থামলি যে বড়ো?
কী আর করি, ও যে বিশে নয়, আমি মিথ্যে করে ওকে বিশে বলে চালাচ্ছি, একথা মাকে কী করে বলি? তাই হাই তুলে বললাম, এখন আমার ঘুম পাচ্ছে, মা।
মা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আলো নিবিয়ে চলে গেলেন। কী যে খারাপ লাগছিল। কালকের দিনটা কেটে গেলেই বাঁচি।
কালকের কথা মনে পড়তেই আবার উঠে বসলাম, কাল আমাদের কাপ পাইয়ে দিয়েই কালো-মাস্টার কঞ্জুর হয়ে যাবে, আর এ-এলাকায় তার টিকিটি দেখা যাবে না।
পরদিন বললামও কালো-মাস্টারকে, তুমি কলকাতায় আমাদের বাড়িতে এসো, কেমন? আমার ডাকটিকিটের খাতা তোমাকে দেখাব।
কালো-মাস্টার জিভ কেটে বললে, কী যে বল কত্তা, তোমার একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই। আজ রাতে তোমাদের নাটককে কাপ পাইয়ে দিয়ে বেমালুম ডুব দেব। কোনো ডালকুত্তাও আর আমাকে শুকে শুকে বের করতে পারবে না। ও কী, নাক দিয়ে জল পড়ছে কেন, কত্তা? কেমন তোমার পেরিস্তানে আবার যাবে, সেখানে তোমার বন্ধু বিশে আসবে, সিংহ আসবে– আমি জলের বোতলে আবার জল ভরে রেখেছি; খালি টিনে মুড়ি, ডালমুট, কুচো নিমকি ভরেছি, বিশেদের খেতে দিয়ো; একটা শিশিতে কিছু মুড়ি-ল্যাবেঞ্চশও রেখে এসেছি, খেয়ো তোমরা।
আমি বললাম, সে কী, তুমি আবার গেলে কী করে? নালা টপকাতে তো তোমার ভয় করে, অথচ তোমাকে বিশে বলে চালাচ্ছি! বিশেদের দেশে কী গভীর সমস্ত
থেমে গেলাম। কালো-মাস্টার বললে, বেশ তো, কাল থেকে আমি গায়েব হয়ে যাব, তোমার সাহসী বিশেকে নিয়ে থেকো তুমি। আচ্ছা এতই যদি ভালো তোমার বিশে, তাহলে বাড়ির লোকদের সঙ্গে চেনা করিয়ে দাওনি কেন শুনি?
আমি বললাম, কে ভালো কে খারাপ সে তুমি বুঝবে না। যে-ই তোমাকে ভালো খাবার খাওয়ায় তুমি তো তাকেই ভালো বল। বিশে আমাদের বাড়ির লোকদের ঘেন্না করে বলেছি-না তোমাকে। ভালো খাবারে সে ভোলে না।
আর বেশি কথা হল না। ড্রেস-রিহার্সালের জন্য সব লোকেরা এসে পড়ল। অবিশ্যি ড্রেস-রিহার্সালে বিশে ছাড়া আর কেউ ড্রেস পরল না– ওমা, কাকে আমি বিশে বলছি, কালো-মাস্টারকে সবাই সারাক্ষণ এমন বিশু-বিশু করে যে আমার সুষ্ঠু ভুল হয়ে যাচ্ছে। অথচ কীসে আর কীসে! যাই হোক, দুপুরে শেষ রিহার্সাল হয়ে গেল, তারপর যে-যার সাজপোশাক গুছিয়ে রাখল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে বিভুদাও গড়গড় করে পার্ট বলতে লাগল! আর বাবা পর্যন্ত বললেন, তা মন্দ কচ্ছে না বটুরা। সমরেশ কি সত্যিই পাঁচশো টাকা দিচ্ছে নাকি?