মহালয়ার দিন সকালে হঠাৎ মা আর নিমকি এসে হাজির। ভালো পড়তে পারুক না পারুক পুজোসংখ্যা দুটোকে দেখে নিমকি যে কী খুশি সে আর কী বলব? তাই শুনে কালো-মাস্টার বললে, তা হলে এবার ছোটকার কাছ থেকে সেই সাদা খরগোশ জোড়াও এনে ওকে দাও। দেখো, আরও কত খুশি হবে।
আরে, সাদা খরগোশের কথা যে ভুলেই গিয়েছিলাম। ছোটকা তখন আহ্লাদে ভরপুর, দুবার বলতে হল না, অমনি চিঠি লিখে দিলেন। সেই চিঠি হাতে করে, আমি নিজে গিয়ে খরগোশ দুটোকে নিয়ে এলাম। বড়োকাকা একটা খাঁচাও কিনে দিলেন। নিমকিটা এমনি বোকা, আমাকে বললে, ইস দাদা, তোমার মতো কেউ নাটক করতে পারে না। কী ভালো খরগোশ রে!
বলে খরগোশের গোঁফে হাত বুলোতে লাগল।
সে যাকগে, অন্যবারের মতো এবারও নাটক হল আমাদের বাড়ির মস্ত পুজোর দালানে। আজকাল আর পুজো-টুজো হয় না সেখানে, তবে ছোটকাদের ক্লাবের নানান ব্যাপার হয়। কী চমৎকার উঁচু স্টেজ বাঁধানো সেখানে। তার দু-পাশে পুজোর জিনিস রাখার ঘর দুটো বেশ আমাদের সাজের ঘর হল।
ড্রেস তো যে-যার নিজেরটা জোগাড় করবে। কালো-মাস্টারের, আমার, বিভুদার আর আমাদের বাড়ির অন্যান্য যারা নাটক করছিল, সক্কলের ড্রেস বড়োকাকা কলকাতার একটা বড়ো দোকান থেকে ভাড়া করে আনলেন। কালো-মাস্টারকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন, সে কিছুতেই গেল না। জিভ কেটে বললে, তাই কখনো হয়? সব যে আমার চেনাজানা, গেলেই হাতে হাতকড়া পড়বে।
বড়োকাকা অবাক হয়ে বললেন, সে কী বিশু, তুমি কি কোনো অন্যায় কাজ করে গা-ঢাকা দিয়ে আছ নাকি? তাহলে তো
বড়োকাকা আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ছোটকা রেগে উঠলেন, বললেন, দেখো মেজদা, যা করেছে করেছে, নাটক শেষ হবার পর তুমিও যা হয় কোরো। এখন যদি টু শব্দটি কর তত ভালো হবে না বলে রাখলাম।
কালো-মাস্টার বললে, কী আর হবে? আমাকে ফাটকে দেবে আর ভোঁদাবাবু কাপ পাবেন। ইনি হয়তো তাই চান।
বড়োকাকা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, কিন্তু চুরি-টুরি করেনি তো, বিশু?
কালো-মাস্টার বললে, অন্যরা যা ইচ্ছে বলতে পারে, আমি ওকে চুরি বলি না। নিজের জিনিস কেউ কখনো চুরি করে?
বড়োকাকা বললেন, ওই তা হলেই হল, বিশু! এ নিয়ে আর আমি কিছু বলব না।
লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের রিহার্সাল চলতে লাগল। ওদিকে পুজোর সাত দিন আগে থেকেই অন্য যত সব প্রতিযোগিতার দলের নাটক শুরু হয়ে গেল। দশটা ক্লাব নাম লিখিয়েছিল। বড়োকাকা ব্যবস্থা করে এসেছেন, আমাদেরটা হবে সবার শেষে, নবমী পুজোর দিনে। তার আগের দিন ভোঁদারা কর্ণার্জুন করবে।
দল বেঁধে আমরা রোজ নাটক দেখতে যাই, শুধু কালো-মাস্টার যায় না। বলে, হাঃ, আর হাসাবেন না স্যার। সারাটা জীবন দেশের সেরা অভিনেতাদের সঙ্গে কারবার করে এলাম, আর এখন আমাকে রিসড়ে-শেওড়াফুলির বাহাদুরদের দেখাচ্ছেন। সে সময়টুকু বরং দাড়িটাড়িগুলোকে গুছোলে কাজে দেবে। ওগুলো জ্যান্ত জানোয়ারের মতো স্যার, রোজ ওদের চেহারা বদলায়।
গেল না কালো-মাস্টার। আমি তাতে নিশ্চিন্তই হলাম। সকলেই এত খুশি, এমন কী, কালো-মাস্টার নিজেও, আর শুধু আমারই কিনা বার বার মনে হত, ওকে বিশে বলে চালানোটা বোধ হয় ঠিক হল না। অথচ তা না করলে নাটকও হত না, চালিয়ে করিই-বা কী? ও তো আর নিজের নামে অভিনয় করবে না। নিজের কথা কিছু বলতেই চায় না।
বাবা এলেন সপ্তমীর আগের দিন সন্ধ্যেবেলায়। আমরা তেজারতি ক্লাবের কংসবধ দেখে ফিরে এসে দেখি হাঁড়িমুখ করে বাইরের ঘরে বসে আছেন। বড়োকাকাকে দেখেই জ্বলে উঠলেন, তুইও যদি ওদের দলে গিয়ে জুটি শম্ভ, তবে আর ওদের কী বলব। গলার বোতাম লাগাও, চাঁদ!–এসে দেখি বাড়িতে একটা লোক নেই, শূন্য পুরী খাঁ-খাঁ কচ্ছে, বামুনদিদি পর্যন্ত বিকেলে রাঁধাবাড়া সেরে থিয়েটার দেখতে গেছে! বলি, তোদের পাড়ার চোরগুলোরও নিশ্চয় থিয়েটার দেখার শখ আছে, নইলে বাড়ির বেবাক জিনিস পাচার হয়ে যায়নি কেন? তবু ওই খেমো চেহারার চাকরটা ছিল, সে-ই আমাকে চা-টোস্ট খাওয়াল। নইলে পৈতৃক বাড়িতে, পুজোর আগের দিন বাবুরা সব যা অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন!– বিকেলে দুধ খেয়েছিলে, চঁদ?– চাকরটা বলল, রোজই নাকি এইরকম হয়। নাঃ, চঁদটার আর কিছু হবে না বুঝতে পারছি, রোজ কলিভার অয়েলটা খাচ্ছিস তো?–যা ইচ্ছে করোগে তোমরা, তবু দে দয়া করে চাকরটাকে রেখে গেছিলে সেইজন্যে আমি কৃতজ্ঞ। যদিও বেটার চেহারাটা স্রেফ চোরের মতো!
আমরা এ-ওর মুখের দিকে চাইলাম। চাকরটা বলতে যে কালো-মাস্টার ছাড়া আর কেউ নয়, এ আমাদের বুঝতে বাকি রইল না। একটু হাসিও পাচ্ছিল এই ভেবে যে এখন যাকে চোর চোর করছেন, একবার তার শিশুপালের সাজ দেখলে তাক লেগে যাবে না!
এদিকে বাবা এসেই আমার রাতে নাটক দেখা বন্ধ করে দিলেন। পাছে নবমীর দিন আমার নাটক করাও বন্ধ করে দেন, সেই ভয়ে কোনো আপত্তি করলাম না। আমি যাব না শুনে নিমকি খুব খানিকটা কেঁদে নিল। শেষটা মা-ও গেলেন না, নিমকিও গেল না। আমাদের তাই ভোঁদার দলের কর্ণার্জুন দেখা হল না। রাতে ফিরে এসে খেতে বসে ছোটকারা খুব হাসাহাসি করতে লাগলেন। নাকি ভালো দাড়ি-গোঁফ পায়নি, সৈনিকদের সব আঁকা দাড়ি, ঘামে গলে চটচট করছিল। গোড়ায় দাড়ি-গোঁফের নাকি কী ব্যবস্থা হয়েছিল, শেষ মুহূর্তে ঝগড়াঝাটি হয়ে সব ভেস্তে গেছিল। ছোটকা বললেন, সহজে বলতে কী চায় ওরা? বুঝলে বিশু, তবু আঁচে জানলাম সিনেমার ওই ভবেশ রায় যে কর্ণ সাজল– কী ছিরির অভিনয় আর, বলিহারি!– ও-ই শেষ মুহূর্তে কোত্থেকে একটা লোক ধরে এনেছিল, সে-ই সবাইকে সাজিয়েছে। নিয়েওছে নাকি দু-শো টাকা, এখন সে টাকা কোত্থেকে আসে তার ঠিক নেই।