–যাবি নাকি আমার সঙ্গে সমুদ্রের জাহাজে?
শুনে আমি অবাক। বিশে ডাঁসা পেয়ারাতে এক কামড় দিয়ে বললে,
যাবি তো বল। তোকে আন্দামান ছাড়িয়ে আরও অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারি। সেখানে একটা প্রবালের দ্বীপ আছে, তার মাঝখানে মস্ত একটা নীল উপসাগর, সেইখানেই আমাদের আস্তানা। বাইরে থেকে কিছু বুঝবার জো নেই, পাথরে-আড়াল করা সরু নালার মতো পথটা দিয়ে একবার ঢুকলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। নারকেল গাছ জড়িয়ে লতা উঠেছে, তাতে থোলো থোলো কালো আঙুর ঝুলছে, পেড়ে খেলেই হল। পাথরের গায়ে কমলামধুর চাক, মধু উপচে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, সিংহ পর্যন্ত চেটে খায়। মাথার ওপর লাল-নীল হিরেমন পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। যাবি তো বল।
যেতে তো খুবই ইচ্ছে করে; কিন্তু মা যে আবার আমাকেই বলেন চিঠি ডাকে দিয়ে আসতে, মুশকিলও আছে ঢের। তার ওপর নিমকি ইস্কুল থেকে ফিরেই বলে, দাদা আমার ঘুড়ি জুড়ে দাও; বাবা বলেন, খবরের কাগজ থেকে এটা-ওটা কেটে রাখতে। বিশের সঙ্গে সমুদ্রের জাহাজে চলে যেতে তো ইচ্ছে করেই, কিন্তু তাহলে এসব করবে কে?
যখন জোয়ার আসে, হুড়হুড় করে নালা দিয়ে জল ভেতরে ঢুকে যায়। বিশের নৌকো এই পাড়িটা অবধি ভেসে ওঠে। সেই সময়ই বিশে আসে। ভাটা পড়লে জল কোথায় নেমে যায়, এক হাঁটু কাদা বেরিয়ে পড়ে, বিশের নৌকো ডাঙার ওপর বসে থাকে, বিশে আর বাঘা তখন চোরা ঘরে বিশ্রাম করে, আমিও আস্তে আস্তে দেয়াল আঁকড়ে মাকড়ে উঠে পড়ি। তারপর বাগানের ধার ঘুরে গিয়ে খিড়কি দিয়ে আবার বাড়িতে ঢুকি। ওরা ভাবে বুঝি বাগানের ঘাটে বসে ছিলাম।
ততক্ষণে হয়তো নাটকের রিহার্সাল শেষ হয়ে গেছে। বড়োরা অনেকেই যে-যার বাড়ি চলে গেছে। বিভুদা, ছোটোকাকা, আরো দু-একজন চাতালের বাঁধানো পাড়ে হাঁড়িমুখ করে বসে ভোঁদার দলের ওপর খুব রাগ দেখাচ্ছেন। আমি আস্তে আস্তে একটা কোনায় এসে বসতেই ছোটোকাকা বললেন,
–অত গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ালে তো চলবে না, চাঁদ! টাকা-পয়সার ব্যবস্থা নেই, কারো পার্ট মুখস্থ হয় না, সাজপোশাকের কী হবে তার ঠিক নেই, তার ওপর আজ আবার এই কাণ্ড! অমন চুপ করে থাকলে তো চলবে না, সবাই মিলে না খাটলে শেষটা কি ভোঁদার দলই এ-বছর কাপ পাবে না কি?
আমি বললাম, আমাকে একটা পার্ট দিলে তবে তো করব।
বিভুদা বললে, না, না, ছোটকা, ওকে কিছু বলাটা ঠিক নয়। ও আমাদের সকলের জন্যে দাড়ি-গোঁফ এনে দেবে।
ছোটোকাকা বললেন, দাড়ি-গোঁফ আর চুল বল।
বিভুদা বললে, ও হ্যাঁ, দাড়ি-গোঁফ আর চুল।
০২.
কী ভালো ভালো সব দাড়ি-গোঁফ দেখেছি লোকদের মুখ থেকে ঝুলে আছে, কিন্তু সেসব আমি পাব কোত্থেকে? তা বিভুদা কিছুতেই বোঝে না। ওদের রিহার্সালে গণ্ডগোল হয়, মেজাজ ওদের বিগড়ে থাকে, তার ঝাল ঝাড়ে আমার ওপর! বলে, খুব বেশি দিন আর নেই চাঁদ, দু-বেলা পেট পুজো আর লবাবি করে ঘুরে বেড়ালে চলবে না। কদ্দূর কী করলি ব?
বলে আমার হাতের কনুইয়ের উপরে দু-আঙুল দিয়ে খিমচে ধরে মাংস টানে। উঃ! কী ব্যথা লাগে, জায়গাটা দড়া পাকিয়ে গোল হয়ে ফুলে ওঠে! তারপর বিভুদা আমার ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, তোর সব চালাকি জানা আছে আমার!! ভালো মানুষ সেজে থেকে আমাকে বকুনি খাওয়াবার যত ফন্দি। যা না, মার কাছে গিয়ে নালিশ কর্না গিয়ে।
বলে, মেয়েদের মতো সরু গলায় বলতে থাকে, ওঁ কাকিমা, পেঁখো না, বিভুদা আঁমাকে খালি খালি মারে, আঁ আঁ আঁ!– ন্যাকা চৈতোন!
ঠ্যালা খেয়ে আমি দেয়ালের ওপর গিয়ে পড়ি। ঠিক সেই সময় ছোটকা এসে পড়েন, বিভুদাকে বলেন,
–বাস্তবিক বিভু, এ-রকম ফ্যাসাদে তো আগে কখনো পড়তে হয়নি। বড়দার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারিস-না? নইলে সব যে ভেস্তে যায়। ভোঁদারা শুনছি কাপ পেয়ে কী ফিস্টি দেবে তার তালিকা তৈরি করছে, বড়ো বড়ো চাদা মাছের ফ্রাই, মুরগির কাটলেট, রাবড়ির আইসক্রিম। আমাদের কাকেও নাকি বলা হবে না।
বিভুদা বললে, অথচ নালুর পইতেতে সব এসে দিব্যি খেয়ে গেছে! ছোঃ! তা তুমি ভেবো না ছোটকা, চাঁদ সব এনে দেবে বলেছে, মেক-আপের জন্য আমাদের একটা পয়সা লাগবে না। ড্রেসও যে-যার নিজেরটা বাড়ি থেকে আনলেই ল্যাঠা চুকে যাবে।
ছোটকাও একটু খুশি হয়ে গেলেন।
–যা বলেছিস। নাটক হবে আমাদের পুজোর দালানে, বাঁধানো স্টেজ তো রয়েইছে, মাথার ওপর তারা ফুটফুট করবে, নীচে শতরঞ্জি বিছিয়ে দেবে, পেছনে কতক চেয়ার দেব ক্লাব থেকে এনে। কিন্তু
এই অবধি বলেই ছোটকা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বিভুদা মহা ব্যস্ত।
-কিন্তু কী, ছোটকা? আবার কিন্তু কীসের? পাট সব মুখস্থ হয়ে যাবে দেখো। ছোটো ছোটো পাঁচটা পাট আমার, তাই মুখস্থ করে ফেলেছি। একটু একটু সাজ বদলে এক এক পাটে নামব, কখনো শুধু গোঁফ, কখনো শুধু দাড়ি, কখনো দাড়ি-গোঁফ দুই, কখনো চাঁচাছোলা, কার সাধ্যি চিনে নেয়– এই চাঁদ, দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেল!
আমি বললাম, তা আমাকে তো দুটো-একটা পাট দিতে পার। নিজে পাঁচটা না করে, আমাকে দুটো নাহয় দিলে। কিচ্ছু ভালো মুখস্থ হয়নি তোমার, পড়া-টড়াও তো সব ভুলে যাও কাকিমা বলেছেন!
ততক্ষণ ওদের দলবল এসে গেছে, ছোটকা চাতালের দিকে চললেন, অমনি বিভুদা আমার উপরে লাফিয়ে পড়ে আমার মুঠো মুঠো চুল ছিঁড়ে, কানের লতি টেনে একাকার করে দিল। উঃ, কী খারাপ ছেলে বিভুদা। আমাকে মেরে-টেরে মুখ মুছে দিব্যি রিহার্সালে চলে গেল।